বাড়ির অমতেও ছাড়েননি নেশা, ৩০০০ শব্দছক তৈরি করে রেকর্ড বাংলার ‘পাজল-ম্যান’-এর

ছিল না সামান্য হাতখরচাও। পরিবারের সদস্যরাও তখন মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছেন। তবে যে-কোনো ভাবেই যে পৌঁছাতে হবে পত্রিকার দপ্তরে। বিনা টিকিটেই তাই রেলযাত্রা। চেকারের কাছে ধরা পড়লে কাগজের নাম, নমুনা দেখিয়ে ছাড়া পাওয়া। আবার কখনো পার্ক সার্কাস নেমে শিয়ালদহ অবধি টানা হাঁটা। নিজের স্বপ্নের জন্য এভাবেই লড়াই করে গেছেন শুভজ্যোতি রায়। যাঁকে বাংলার ‘পাজল-ম্যান’ বললেও ভুল বলা হয় না এতটুকু।

দৈনিক সংবাদপত্র হোক কিংবা সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকা। শব্দছক পত্রিকার সঙ্গে জড়িয়ে গেছে অঙ্গাঙ্গিকভাবেই। আর যাঁদের এই শব্দের ধাঁধাঁ সমাধানের নেশা রয়েছে, তাঁরা অনেকেই শুভজ্যোতি রায় নামটার সঙ্গে পরিচিত। কারণ বাংলার প্রথম সারির সমস্ত পত্রিকাতেই কখনো না কখনো শব্দছক তৈরি করেছেন সন্তোষপুরের এই বাসিন্দা। শব্দের সঙ্গেই যাঁর সংসার, একাত্মতা।

তবে শুরুটা হয়েছিল বেশ আকস্মিকভাবেই। বাবা ভজহরি রায় ছিলেন পোদ্দারনগর হাই স্কুলের বাংলা শিক্ষক। কাজেই মাতৃভাষায় একটা দখল তো ছিলই ছোটো থেকে। তখন নবম শ্রেণী। আলাপ হল পত্রিকায় প্রকাশিত শব্দছকের সঙ্গে। তবে খানিক চেষ্টা করতেই তার সম্পূর্ণ সমাধান করে ফেলেছিলেন বছর পনেরোর শুভজ্যোতি। সেইসঙ্গেই অনুভব করেছিলেন এক অপার্থিব আনন্দ। 

এরপর থেকে একরকম নেশাই হয়ে গিয়েছিল শব্দছক, বলছিলেন শুভজ্যোতিবাবু। “তারপর থেকে কাগজ বাড়িতে এলেই শব্দছক কাচি দিয়ে কেটে বইয়ের ভেতরে করে স্কুলে নিয়ে যেতাম আমি। ক্লাসের প্রথমদিকের ছেলেরা সবসময় সামনের বেঞ্চে বসে। কিন্তু আমার রোল তিন হওয়া সত্ত্বেও আমি বসতাম শেষের বেঞ্চে। ক্লাস চলাকালীন সমাধান করতাম সেইসব শব্দছকের।” তবেও ধরাও পড়েছেন শিক্ষকদের কাছে। নিজের বাবাও ওই একই স্কুলের শিক্ষক হওয়ায় বার করে দিয়েছেন ক্লাস থেকে। বকুনি তো ছিলই। তবে এসব কিছুর পরও দমেনি শব্দছকের প্রতি টান। বরং অদম্য জেদের বশে সেই শব্দছককেই বানিয়ে নিয়েছেন নিজের পেশা।

“১৯৯৮ সালে ক্লাস টেনে পড়ার সময় তখন খুব জুরাসিক পার্কের চল ওঠে। সেইসময়ই আমি প্রথম কোনো শব্দছক তৈরি করি। ডাইনোসরদের নিয়ে। সেটা বর্তমান পত্রিকাতে পাঠিয়েছিলাম। ওরা ছেপেওছিল। বর্তমানের দপ্তরে দেখা করতে গেলে আমার বয়স দেখেই চমকে যান ওই বিভাগের এডিটর। তিনিই আমাকে বলেছিলেন শব্দছককে ছেড়ো না। তোমাকে অনেকদূর যেতে হবে”, পেশায় আসায় শুরুর দিনগুলোর কথা বলছিলেন শুভজ্যোতিবাবু।

আরও পড়ুন
বাঙালির প্রযুক্তিতে বাজিমাত, কলকাতায় অঞ্চলভেদে দূষণের মাত্রা জানাবে নয়া যন্ত্র

শব্দছকের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই এমন ‘টার্ন-ওভার’ সত্যিই বিস্মিত করে দেবে যে কাউকে। ক্লাস টেন থেকেই ধীরে ধীরে শব্দছকই তাঁর ধ্যান-জ্ঞান হয়ে উঠছিল। ঘরে ভরে যাচ্ছিল একের পর এক শব্দকোষের সংগ্রহে। তবে এর মধ্যেই মাথা চাড়া দিল অন্য এক প্রতিকূলতা। পরিবারের অমত। কারণ শব্দের নেশায় আশানুরূপ হল না উচ্চ-মাধ্যমিকের ফলাফল। নিজেও আর উচ্চশিক্ষার দিকে ঝুঁকতে চাননি শুভজ্যোতিবাবু। অথচ বাবা শিক্ষক, দিদি ডাক্তার। সুতরাং, বাড়িতে তৈরি হল এক বিরূপ পরিবেশ। 

“আমি বাড়িতে একমাত্র নন-গ্র্যাজুয়েট। আত্মীয়স্বজনদের কাছে ব্যাপারটা একদমই গ্রহণযোগ্য ছিল না। শিক্ষিত পরিবারের ছেলে বখাটে হয়ে গেছে। এমনটা ধারণা ছিল তাঁদের। পণ্ডিতের ছেলে মূর্খ, এমনই এক কথা চাউর হয়ে গিয়েছিল আমার ব্যাপারে। মাথানত হয়েছিল বাবার। হাতখরচা তো দূরের কথা। কথা বলাও বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। একটা ঘরে আমি একাই থাকতাম সেই সময়ে”, শুভজ্যোতিবাবুর কথায় উঠে আসছিল লড়াইয়ের দিনগুলোর গল্প। 

আরও পড়ুন
ইউরোপের ক্লাবে খেলা প্রথম ভারতীয় ফুটবলার; কলকাতা মনে রেখেছে এই বাঙালিকে?

উপার্জন তো করতে হবে কোনোভাবে। তাই একটি পত্রিকাতেই প্রথম শুরু হল কাজ করা। পারিশ্রমিক মাত্র তিনশো টাকা। ওইটুকু অর্থবলেই নিজের সমস্ত খরচ চালাতেন তিনি। ধীরে ধীরে এক বড়ো মিডিয়া হাউসের সঙ্গে পরিচয় হল শুভজ্যোতিবাবুর। সেখানে কাজ শুরু করলেন তিনি। তবে মতবিরোধ লেগেই থাকত মাঝে মাঝে। সব কিছু মানিয়ে নিয়েই চলল লড়াই। আর ধীরে ধীরে ঘরে বাড়তে থাকলে কাগজের বাণ্ডিল। থরে থরে সাজানো পত্রিকা। তাদের সবগুলোতেই প্রায় নিজের তৈরি শব্দছক। এমনই এক মিউজিয়াম হয়ে গেল যেন শুভজ্যোতিবাবুর এক কামরার পৃথিবী।


২০১৮ সালে সংখ্যাটা ছাড়িয়ে গেল সতেরশো। দেশের কনিষ্ঠতম শব্দছকের জন্মদাতা হিসাবে স্বীকৃতি এল ইন্ডিয়া বুক অফ রেকর্ডসের। শুধু সতেরশোর বেশি শব্দছকই নয়। আরও একটি রেকর্ডও রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ৫২টি বিষয় ভিত্তিক শব্দছক। যাতে দুর্গাপুজো, কালীপুজো থেকে শুরু করে উত্তমকুমার, রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিমচন্দ্র বাদ নেই কেউ-ই। আর কোনো বাঙালিরই এই রেকর্ড নেই। এখনও অবধি অক্ষুণ্ণ রয়েছে সেই রেকর্ড। তবে শুভজ্যোতিবাবুর তৈরি শব্দছকের সংখ্যা গত দু’বছরে ছুঁয়েছে প্রায় তিন হাজারে। যা আরও একটি রেকর্ড হতে চলেছে। লিমকা রেকর্ডসে নাম নথিভুক্ত করেছিলেন শুভজ্যোতি রায়। মিলেছিল প্রত্যুত্তরও। তবে করোনা পরিস্থিতির কারণে তা বন্ধ রয়েছে। সামনের জানুয়ারিতেই মুকুটে জুড়বে সেই পালক। 

আরও পড়ুন
বাঙালির হাত ধরেই নামছে বাংলার প্রথম কার রেসিং টিম

এই সম্মানগুলিই ধীরে ধীরে বদলে দিয়েছে তাঁর বাড়ির পরিস্থিতিও, জানালেন শুভজ্যোতিবাবু। “২০১৮ সালে রেকর্ড তৈরির পর যখন বাড়িতে সাংবাদিকরা আসতেন ঘনঘন, তখন বাবা চমকে গেলেন। শব্দছকের প্রতি আমার এই ভালোবাসাটা কোথাও গিয়ে মান্যতা পেয়েছিল তখন। ধীরে ধীরে তখন সংসারের খরচ আমি নিই। জিজ্ঞেস করলে বলতাম এটা আমার উপার্জনের টাকা।” এ যেন এক ঘুরে দাঁড়ানোর অদ্ভুত গল্প।

শুভজ্যোতিবাবুর এখন লক্ষ্য গিনেস বুকের দরজায় পৌঁছানোর। প্রথম বাঙালি হিসাবে ৫০০০ শব্দছকের স্রষ্টা হওয়ার পর সেখানে আবেদন করতে চান তিনি। তবে তার জন্য যে খুব বেশিদিনের অপেক্ষা, তেমনটা একেবারেই নয়। কারণ বর্তমানে দিনে ৫-৬টা শব্দছক তৈরি করা নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত হয়েছে তাঁর। কখনো কখনো সেই সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়ায় ১০-১২টায়। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় তাঁর এই কর্মযজ্ঞ। চলে ১২টা অবধি। দুপুরে ঘণ্টা তিনেক বিশ্রাম নিয়েই আবার সন্ধে ৮টা অবধি চলে কাজ। আবার খানিকটা বিরতি নিয়ে রাতে আরও ঘণ্টা দুয়েক। ফলে বছর দুয়েকের মধ্যেই বাংলায় আসতে চলেছে আরও একটি গিনেস রেকর্ড। 

প্রতিদিনের এই অমানসিক পরিশ্রমের পরেও ক্লান্ত হন না তিনি। ক্লান্তি কি আসে না? এলে শরণাপন্ন হন সিনেমার। যে কোনো সিনেমা নয়। বিভিন্ন বিখ্যাত ব্যক্তির বায়োপিক। নতুন করে আবার কাজে লেগে পড়ার উদ্যোম খুঁজে পান তিনি তাতে। আবার শুরু হয় অনন্তের দিকে এক লড়াই। শব্দের সঙ্গে টানাপোড়েন, ঝগড়াঝাটি, খুনসুটি। 

২০২১ সালে তিনি প্রকাশ করতে চলেছেন একটি বাংলা শব্দছকের গেম। গুগল প্লে-স্টোরেই মিলবে সেই গেম। বিনামূল্যেই নামিয়ে নেওয়া যাবে ফোনে। কাজও শুরু হয়েছে তার। সেখানে দৈনিক শব্দছকের পাশাপাশি চলবে বিভিন্ন প্রতিযোগিতাও। 

কথা বলতে বলতেই অকপট স্বীকারোক্তি শোনা যায় শুভজ্যোতিবাবুর মুখে। “যতদিন বাঁচব এই শব্দছক নিয়েই বাঁচব আমি। এখনও অবধি বহু কাজের অফার পেয়েছি আমি। কিন্তু শব্দছক ছাড়া অন্য কোনো কাজই নিইনি। যেতেও চাই না ভবিষ্যতে।” ভালোবাসার প্রতি ঠিক এমনটাই সততা থাকার দরকার হয় হয়তো। একদিন যখন তিনি থাকবেন না, তখন যেন সংরক্ষিত হয় তাঁর সমস্ত কাজ। তাঁর চাওয়া বলতে শুধু এই টুকুই। হাজার হাজার পত্রিকার সংখ্যায়, ইন্টারনেটেও ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর সৃষ্টিরা। তারাই যেন দলিল হয়ে গেছে এই লড়াইয়ের। একদিন নিশ্চয়ই সম্পূর্ণরূপে ডকুমেন্টেড হবে তা, আশা রাখার এইটুকুই। আর তা না হয়ে যায়ই বা কোথায়?

Powered by Froala Editor

More From Author See More