হকিই তাঁর ‘ধর্ম’, অথচ সন্তানদের হকি খেলায় প্রবল আপত্তি ছিল ধ্যানচাঁদের

দিনের আলো তখন ফুরিয়েছে। রাতের বাতিগুলোর টিমটিমে আলোতে অত বড়ো মাঠটির অন্ধকার ঘোচে না। ভরসা বলতে একমাত্র চাঁদের আলো। সারাদিনের হাড়ভাঙা পরিশ্রম সেরে নিজেদের ঘরের দিকে ফিরছে সৈনিকরা। শুধু একটি ছেলেকে দেখা যায় মাঠে। বয়স কত হবে? বড়োজোর ১৬। এই কদিন আগে, মানে ১৯২২ সালে ব্রিটিশ আর্মিতে ঢুকেছে। কিন্তু নেশা একটাই— হকি! দিনভর খাটনির পর সন্ধেবেলা হকি স্টিক হাতে মাঠে নামতেই যেন অমানবিক শক্তি বাসা বাঁধে শরীরে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা চলে প্র্যাক্টিস। চাঁদের আলোর রুপোলি আভায় ঘামে ভেজা শরীরটা নিয়ে ছুটে চলে গোলের দিকে। যেন হকি স্টিক হাতে এক জাদুকর! সহকর্মীরা তাঁর নাম দিলেন চাঁদ।

ধ্যান সিং হয়ে উঠলেন ধ্যানচাঁদ (Dhyan Chand)। সারা বিশ্ব তাঁকে চেনে ‘হকির জাদুকর’ (Magician of Hockey) নামে। শুধু ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা থাকলেই হয় না, অক্লান্ত পরিশ্রম আর অধ্যাবসায় দিয়ে গড়ে তুলতে হয় নিজেকে। তবেই করা যায় বিশ্বশাসন। পরাধীন দেশের হয়ে ১৯২৮, ১৯৩২, ১৯৩৬-এ হকি অলিম্পিকসে স্বর্ণপদক জয়ের মূল কাণ্ডারি তো তিনিই। আক্ষরিক অর্থেই তখন ভারতীয় হকির ‘সোনার সময়’। ১৯৪৮-এ অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত তাঁর নামের পাশে লেখা ছিল ৪০০টি গোল। 

ধ্যানচাঁদের জন্ম ১৯০৫ সালে এলাহাবাদে। বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে। বদলির ডিউটি—ফলে ছোটোবেলাতে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরার পর অবশেষে ঝাঁসিতে থিতু হন। বাবার পথ ধরেই চলে আসেন সেনাতে। প্রথমে হকি নিয়ে অত মাতামাতি ছিল না। বলা যায়, সেনাবাহিনীতে ঢোকার পরেই হকি স্টিক যেন জাদুদণ্ডের মতো খুঁজে নিল তাঁকে। বাকিটা তো ইতিহাস। 

১৯২৮-এর আমস্টারডাম অলিম্পিকসে ঘরের মাঠে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ভারতের ঝুলিতে ঢুকল প্রথম স্বর্ণপদক। অসুস্থ শরীর নিয়েও ২ গোল করেছিলেন ধ্যানচাঁদ। ভারত জিতেছিল ৩-০ গোলে। টুর্নামেন্টের পাঁচ ম্যাচে তাঁর গোলসংখ্যা ছিল ১৪। আরও আকর্ষণীয় ১৯৩৬-এর বার্লিন অলিম্পিকসের গল্প। যা পরিচিত হয়ে আছে ‘হিটলারের অলিম্পিকস’ নামে। অথচ সারা জার্মানি জুড়ে প্রচারিত হচ্ছে ধ্যানচাঁদের নাম। হকি স্টেডিয়ামে চলছে এক ভারতীয় জাদুকরের খেলা—এই জাতীয় পোস্টারে ছয়লাপ বার্লিন। ফাইনালে মুখোমুখি জার্মানি। দর্শকাসন স্বয়ং হিটলার। ফলাফল ছিল ভারতের পক্ষে ৮-১। ধ্যানচাঁদের হ্যাটট্রিক দেখেই মাঠ ছাড়েন হিটলার। তারপর প্রস্তাব দেন, জার্মানির নাগরিকত্ব গ্রহণের। সঙ্গে দেওয়া হবে মেজর পদ। 

আরও পড়ুন
‘ম্যাজিশিয়ান’ ধ্যানচাঁদকে জার্মানির নাগরিকত্ব দিতে চাইলেন মুগ্ধ হিটলার!

প্রত্যাখ্যান করেছিলেন ধ্যানচাঁদ। তখন তিনি সদ্যবিবাহিত। বিয়ের মাত্র দশদিন পরেই চলে যেতে হয়েছে দেশের কাজে। বাড়ি ফিরতেই স্ত্রী জানকী দেবীর জিজ্ঞাসা, তাঁর জন্য কী আনা হয়েছে? উত্তরে স্বর্ণপদকটি হাতে তুলে দিলেন ধ্যানচাঁদ। কম যেতেন না ভাই রূপ সিং-ও। তিনিও সেই সময়ের বিখ্যাত হকি খেলোয়াড়। জাতীয় দলেও একসাথে খেলেছেন দীর্ঘদিন। ১৯৩২-এর অলিম্পিকে দু-ভাই মিলে প্রবল ব্যতিব্যস্ত করেছিলেন প্রতিপক্ষদের। সেবার ভারত আমেরিকাকে ২৪-১ গোলে এবং জাপানকে ১১-১ গোলে হারায়। ৩৫টি গোলের মধ্যে ধ্যানচাঁদের গোল ছিল ১২টি। রূপ সিং-এর ১৩টি। বিশ্বের কাছে তাঁরা পরিচিতি হলেন ‘হকি টুইনস’ নামে। 

আরও পড়ুন
৪৫ বছর আগে, হকিতে ভারতের একমাত্র বিশ্বকাপ জয় পাকিস্তানকে হারিয়েই

একটি বিষয়ে প্রবল অহংকার ছিল তাঁর। ১৯৬৩-র একটি ইন্টারভিউতেও বলেছিলেন, ইউরোপীয়রা ড্রিবল শিখেছে ভারতীয়দের থেকে। কোথায় পা রাখা উচিত, কোথায় মাথা—এগুলোর ধারণা তাঁদের ছিল না। বার্লিনের বিশ্বকাপের সময় ওদের ফটোগ্রাফাররা স্লো-মোশনে ছবি তুলে পৌঁছে দিতেন জাতীয় দলগুলির হাতে। শুধুই কি অহংকার মিশে আছে কথাটির মধ্যে? নাকি চাপা আক্ষেপও? ভারতীয়দের শিখেই তো ইউরোপের হকিদলগুলি শাসন করছে সারা বিশ্ব। আর ভারত চলে গেছে বেশ কিছুটা পিছনে।

১৯৭৬ সালের ঘটনা। চলছে মন্ট্রিল অলিম্পিকস। ভারত শেষ করে সপ্তম স্থানে। হতাশায়-ক্ষোভে-দুঃখে নাকি কেঁদে ফেলেছিলেন ধ্যানচাঁদ। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, অনভ্যাসের কৃত্রিম টার্ফে খেলায় নাকি শোচনীয় হয়েছে ভারতীয় দলের ফল। তিনি মানেননি এইসব অজুহাত। খুব কাছ থেকে দেখেছেন হকির ভিতরকার রাজনীতি, দেখেছেন পরিকল্পনার অভাব। এই পরিকাঠামোয় সোনার আশা করা বোকামি! করতে চেয়েছিলেন অনেক কিছুই। কিন্তু বাঁধা ছিল হাত-পা।

তিনি কি পূর্বেই বুঝতে পেরেছিলেন এই অন্ধকার ভবিষ্যতের ইঙ্গিত? দেখেছিলেন, ভারতীয় হকি খেলোয়াড়দের আবেগ কমছে, বড্ড পেশাদার হয়ে পড়ছে সব কিছু। নিজের ধ্যানজ্ঞান সব ছিল হকি, অথচ নিজের সন্তানদের হকি খেলা নিয়ে প্রবল আপত্তি ছিল। তাঁরা পড়াশোনা করুক, চাকরি করে প্রতিষ্ঠিত হোক, কিন্তু হকি মাঠে যেন না আসে। ছেলেরা অবশ্য লুকিয়ে হকি খেলা চালিয়ে গেছেন। পুত্র অশোক কুমার ছিলেন ১৯৭৫-এর হকি বিশ্বকাপ চ্যাম্পিয়ন দলের সদস্য। 

পদ্মভূষণ পুরস্কার পান ১৯৫২ সালে। বর্তমানে ২৯ আগস্ট, তাঁর জন্মদিন পালন করা হয় ‘জাতীয় ক্রীড়া দিবস’ রূপে। তাতেই কি ফুরিয়ে যায় কর্তব্য? শেষ জীবন কেটেছিল আর্থিক অভাবের মধ্যে। সম্বল বলতে ছিল পেনশন। বিদেশে নাগরিকত্বের একাধিক প্রস্তাব ত্যাগ করেছিলেন দেশের প্রতি ভালোবাসার জন্য। হকি ছিল তাঁর ‘ধর্ম’। অবশ্য সম্প্রতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে পুরুষ ও মহিলা ভারতীয় হকি দল। তাঁর বিশ্বাসের হাত ধরেই কি ফিরবে ভারতীয় হকির ‘সোনার সময়’?

তথ্যঋণ :
ধ্যানচাঁদ, নির্মলকুমার সাহা

Powered by Froala Editor