তালিবান জমানায় কোথায় আছেন বিশ্ববিখ্যাত ‘দ্য আফগান গার্ল’?

বছর পাঁচেক আগের কথা। পাকিস্তানের ন্যাশানাল ডেটাবেস অ্যান্ড রেজিস্ট্রেশন অথরিটি নাগরিকদের পরিচয়পত্র খতিয়ে দেখতে দেখতে পেলেন একটা ছবি। এক মহিলার। স্থানীয় সরকারি কর্মচারীরাও চেনেন তাঁকে। চেনেন সংস্থার উচ্চপদস্থ আধিকারিকরাও। তবে তা ছবির চেনা। ‘দ্য আফগান গার্ল’ নামে পৃথিবীবিখ্যাত সেই ছবি। সেই উজ্জ্বল সবুজ চোখ আর মাথায় লাল ওড়না। তবে এখন হাতে নিয়ে যে ছবি তাঁরা দেখছেন, তাতে বয়সের ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু তবু চিনতে অসুবিধা হয় না। পরেরদিন পাকিস্তানের সমস্ত খবরের কাগজের পাতায় বেরোল সেই ছবি। গ্রেপ্তার হলেন শরবত গুলা। আফগানিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে বে-আইনিভাবে দুই সন্তানকে নিয়ে পাকিস্তানে বসবাস করছেন আফগানিস্তানের এই মহিলা। তবে এমন বে-আইনি অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা তখন অনেক। শরবত তাঁদের থেকে একটু আলাদা।

কে এই শরবত? উত্তর খুঁজতে গেলে পিছিয়ে যেতে হবে ১৯৮৪ সালে। তখন আফগানিস্তান রুশ সেনাবাহিনীর অধিকারে। আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির সাপেক্ষে উঠে আসছে নানা পুরনো ছবি। আর তার ফলেই আবারও আলোচনায় উঠে এসেছে এই ছবি। ‘দ্য আফগান গার্ল’। আসলে এই ছবিই এক ইতিহাস। পশ্চিমের চোখে আফগানিস্তানকে দেখা। ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের পাতায় প্রকাশিত এই ছবি সারা বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিল আফগানিস্তানের সেই সময়ের পরিস্থিতি। ছবিটা তুলেছিলেন স্টিভ ম্যাককুরি। তবে সেই সদ্য কৈশোর পেরনো মেয়েটির কোনো পরিচয় তিনি দিতে পারেননি। শুধু বলেছিলেন পাকিস্তানের নাসিরবাগ রিফিউজি ক্যাম্পে থাকেন এই কিশোরী। ছবিটি তোলার সময় সে নাকি টের পেয়ে তাকিয়েছিল একবার। আর সেই সন্দেহ এবং রাগ মিশ্রিত দৃষ্টিই ধরা পড়েছিল ক্যামেরার শাটারে।

ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের পাতায় সেই ছবি আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। রুশ শাসনে আফগানিস্তানের অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও পস্তুন সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর চলছিল অকথ্য অত্যাচার। অনেকেই প্রাণভয়ে পাকিস্তানে পালিয়েছিলেন। আর তাঁদের অনেকেরই ঠিকানা হয়েছিল এই নাসিরবাগ রিফিউজি ক্যাম্প। আধুনিক আফগানিস্তানের এক বিপ্রতীপ ছবি সেখানে। অনেকে সেই ছবিকে তুলনা করেছিলেন ভিঞ্চির মোনালিসার সঙ্গে। সমালোচকরা বলেছিলেন, পশ্চিমের চোখে প্রাচ্যের মোনালিসা।

ছবিটির এই জনপ্রিয়তাই ম্যাককুরিকে বাধ্য করল আবার সেই মেয়ের সন্ধানে বেরিয়ে পড়তে। তখন ১৯৯০ সাল। ততদিনে নাসিরবাগ রিফিউজি ক্যাম্প ভেঙে গিয়েছে। অনেকেই আফগানিস্তানে ফিরে গিয়েছেন। কেউ আবার পাকিস্তানেই থেকে গিয়েছেন পাকাপাকিভাবে। সেখানে সংসারও পেতে ফেলেছেন। সেই পরিস্থিতিতে কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে অজ্ঞাতপরিচয় সেই মেয়েকে? পশ্চিমের দেশগুলিতে ছবিটি সবার পরিচিত। অথচ নিজের পাশের মানুষটিকে সেভাবে চেনেনই না এই দরিদ্র পস্তুনরা। ম্যাককুরিকে ছবি নিয়ে খুঁজতে দেখে অনেকেই প্রথমে পুলিশের লোক ভেবে সন্দেহ করেছিলেন। সেই ভুল ভাঙতে অনেকে ভেবেছিলেন এই বিদেশি বুঝি সেই মেয়ের জন্য কোনো পুরস্কার নিয়ে এসেছে। ফলে অনেকেই ভিড় করে দাঁড়াতেন। আর প্রায় একই সাজপোশাকের আড়ালে মানুষগুলোও এতটাই একরকম, যে ম্যাককুরিরও ভ্রম লেগে যেত। তবে প্রায় ১২ বছর অক্লান্ত পরিশ্রমের শেষে সন্ধান পেলেন তার। ২০০২ সাল। শরবত তখন আবার ফিরে গিয়েছেন আফগানিস্তানে। তাঁর নিজের ছবি সেই প্রথম দেখলেন তিনি। কেউ যে ছবি তুলেছিল, তা তাঁর মনে আছে। এও জানতেন, সেটাই তাঁর তখনও পর্যন্ত একমাত্র ছবি। কিন্তু তা তিনি দেখেননি।

আরও পড়ুন
আফগান সহকর্মীদের ছেড়ে দেশে ফিরতে নারাজ প্রাক্তন ব্রিটিশ সেনা

২০০২ সালে আবার ছবি তোলা হল তাঁর। দুই সময়ের ছবি পাশাপাশি দেখা গেল ন্যাশানাল জিওগ্রাফিকের পাতায়। পাকিস্তানের আমলারাও সেই ছবিই দেখেছিলেন। আবার সেই মুখ দেখলেন ২০১৬ সালে। মার্কিন শাসনে থাকা আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন শরবত। সঙ্গে দুই পুত্র। অবশ্য পরে জানা যায়, তারা শরবতের নিজের ছেলে নয়। শরণার্থীরা এভাবেই একজন আরেকজনের সন্তানকে প্রতিপালন করেন। হয়তো সীমান্ত পেরিয়ে পাকিস্তানে আসার পথেই ছেলেদুটির নিজের বাবা-মা মারা গিয়েছেন। এত খবর অবশ্য কেউ আর রাখেননি। কিছুদিন জেলে কাটানোর পর আবারও আফগানিস্তানে ফিরতে হয়েছিল আফগানিস্তানে। প্রেসিডেন্ট আসরফ গনি অবশ্য সাদরে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন শরবতকে। বলেছিলেন, তাঁর নিরাপত্তার সমস্ত দায়িত্বও নেবেন। কিন্তু তালিবানদের হাতে দেশকে বিনাযুদ্ধে ছেড়ে দিয়ে আজ গনিই চলে গিয়েছেন। শরবত কি এখনও বেঁচে আছেন? নাকি গত যুদ্ধে বহু মানুষের মতো তিনিও প্রাণ হারিয়েছেন? বেঁচে থাকলে আগামীদিনগুলো কেমন কাটবে? পস্তুনদের নিরাপত্তার প্রতিশ্রুতি কি রাখবে তালিবানরা? নাকি আবারও পাকিস্তানে পালানোর চেষ্টা করবেন শরবত? একটা ছবিকে ঘিরে আজও রয়ে গিয়েছে এত প্রশ্ন! শরবত তো একজন নন, তিনি আফগানিস্তানের মুখ।

আরও পড়ুন
ঘরছাড়া ৬০০০ বাঙালি, আশ্রয় দিয়েছিল আফগানিস্তান!

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
তালিবানি আগ্রাসনের মধ্যেই শান্তির স্বপ্নে বুঁদ আফগানিস্তানের মহিলা সাংবাদিক