অষ্টাদশীর স্বপ্নপূরণ, বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামে লাইব্রেরি তৈরি রাহিলার

পাশাপাশি দুটি ঘর মিলিয়ে সংসার। তারই একটিতে থরে থরে সাজানো বই। সামনে কিছু চেয়ার। আর মাটিতে বড়ো করে সাদা চাদর বিছিয়ে বিছানা করা। আয়োজন সামান্যই। কিন্তু এই ছোটো লাইব্রেরির পিছনেই রয়েছে অনেকটা জেদ আর পরিশ্রম। দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার ফলতা থানার আসিনা গ্রামের কিশোরী রাহিলা খাতুনের হাত ধরেই এভাবে বেঁচে রয়েছে গ্রামের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার স্বপ্ন।

“আমাদের গ্রামে লেখাপড়ার সুযোগ তো সামান্যই। লকডাউনের সময় সব স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেই সুযোগটুকুও আর থাকল না। কিন্তু পড়াশোনা বন্ধ করে দিতে চাইনি আমরা কেউই। আর সেই কারণেই এই লাইব্রেরি তৈরি করা।” বলছিল সদ্য আঠারো ছুঁই ছুঁই রাহিলা। দ্বাদশ শ্রেণির পড়ুয়া রাহিলা এবছরই উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় বসবে। কিন্তু একদিকে করোনা আর অন্যদিকে আমফানের মিলিত আক্রমণে সেই সব স্বপ্নই হারাতে বসেছিল। “আমাদের গ্রামের অধিকাংশ মানুষই পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে বাইরে কাজ করেন। লকডাউনে সবাই কর্মহীন হয়ে পড়েন। আমাদের খাবারের সংস্থানও ছিল না। তখন ত্রাণের কাজ করতে কয়েকজন আসেন। তাঁদের মধ্যেই দুজন আমাদের জন্য কিছু বই কিনে দেওয়ার কথা জানান।” তবে গ্রামের সমস্ত ছেলেমেয়ের জন্য তো আলাদা আলাদা বই কিনে দেওয়া সম্ভব নয়। সবার পড়াশোনার একটা সাধারণ জায়গা দরকার।

এই সময়েই এগিয়ে এসেছিলেন রাহিলার মা ফতিমা। অষ্টম শ্রেণি অবধি পড়াশোনা ফতিমার। কিন্তু নিজের মেয়ে ও বাকিদের পড়াশোনা মাঝপথে থেমে যাবে, এটা মেনে নিতে পারেননি। নিজের বাড়ির দুটি ঘরের একটি ছেড়ে দিলেন লাইব্রেরি তৈরির জন্য। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির প্রতিটি বিষয়ের পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও রয়েছে ২-৩টি সহায়ক বই। এর মধ্যেই স্নাতক স্তরেরও বেশ কিছু বই সংগ্রহ করেছে রাহিলারা। এখন অবশ্য স্কুল-কলেজ খোলার বিষয়ে চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে গিয়েছে। কিন্তু এই চার দেয়ালের ছোট ঘরে বসে একসঙ্গে পড়াশোনার যে স্বাদ তারা পেয়েছে, সেটা হারিয়ে ফেলতে রাজি নয় রাহিলারা। এই লাইব্রেরিকে তাই আরও বড়ো করে তুলতে হবে, এটাই এখন তাদের প্রতিজ্ঞা।

মেঝেতে লাল অক্ষর দিয়ে লেখা ‘জননী’। এই শব্দের সত্যিই কোনো ধর্মভেদ নেই। মাতৃত্বের অনুভূতি দিয়েই সাজানো একটি লাইব্রেরি। বইয়ের বৈচিত্রে কোনো গ্রন্থাগারকেই হয়তো টেক্কা দিতে পারবে না। কিন্তু এই বিষাদ ভরা সময়েই যেন এক টুকরো স্বপ্নের আকাশকে বন্দি করতে চায় রাহিলারা। এভাবেই শিক্ষার আলোকে বাঁচিয়ে রাখুক রাহিলা-ফতিমারা। মায়েদের হাতেই তো ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি হয়।

আরও পড়ুন
চায়ের দোকানেই ওপেন লাইব্রেরি, তরুণদের হাত ধরে ‘বই-বিপ্লব’ বর্ধমানে

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
বাতিল বই কুড়িয়েই আস্ত লাইব্রেরি, কলম্বিয়ার ‘বইয়ের রাজা’ এক সাফাইকর্মী