একটানা ৩২ বছরের ‘ঘুম’ কিশোরীর, থই পাননি চিকিৎসকরাও

পরিসংখ্যান বলছে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮ ঘণ্টা ঘুমায় মানুষ। অর্থাৎ, জীবনের এক তৃতীয়াংশ ঘুমিয়ে কাটায় মানুষ। সেই হিসাবে দেখতে গেলে এক জীবনে ৩০ বছর ঘুমাতে গেলে অন্তত ৯০ বছর জীবিত থাকতে হবে কোনো মানুষকে। কিন্তু এই সমীকরণটাই যদি বদলে যায় হঠাৎ করে? একটানা যদি ৩২ বছরের ঘুমে আছন্ন হয়ে পড়ে কোনো ব্যক্তি? 

চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাস সাক্ষী রয়েছে এমনই এক আশ্চর্য ঘটনার। দু’-এক বছর নয়, একটানা ৩২ বছর ঘুমিয়ে চিকিৎসকদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছিলেন সুইডেনের এক কিশোরী। 

ক্যারোলিনা ওলসন (Karolina Olsson)। ১৮৬২ সালে সুইডেনের (Sweden) ওকনো দ্বীপে জন্ম ক্যারোলিনার। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সবচেয়ে কনিষ্ঠ ছিলেন তিনিই। আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মতোই বেড়ে উঠেছিলেন ক্যারোলিনা। তবে একটা অতিসামান্য দুর্ঘটনাই বদলে দেয় তাঁর জীবনের চাকা। সেটা ১৮৭৬ সালের শীতকাল। ক্যালেন্ডারের পাতায় তারিখটা ২২ ফেব্রুয়ারি। চতুর্দিক ঢেকে গেছে বরফে। স্কুল থেকে ফেরার পথে সেই বরফেই পা-পিছলে পড়ে যান ১৪ বছর বয়সি কিশোরী। আঘাত লাগে মাথায়। 

অবশ্য সেই আঘাত যে প্রচণ্ড গুরুতর ছিল বা আঘাত পাওয়ার পরই জ্ঞান হারিয়েছিলেন তিনি— ব্যাপারটা এমন নয় মোটেই। বাকি পথ দিব্যি পায়ে হেঁটেই বাড়িতে ফেরেন ক্যারোলিনা। তবে ক্লান্তির জন্য অন্যান্য দিনের থেকে একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েন তিনি। ৩২ বছরের দীর্ঘ ঘুমের সূচনা হয় সেই থেকেই। হ্যাঁ, ১৮৭৬-এর ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯০৮ সালের ৫ এপ্রিল— টানা ১১৭৩০ দিন অর্থাৎ প্রায় ৩২ বছর একটানা ঘুমিয়েছিলেন ক্যারোলিনা। 

অবশ্য তাঁর ঘুম দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে থাকবে, সে-সময় তার বিন্দুমাত্র আন্দাজ পাননি তাঁর পরিবারের সদস্যরাও। একাধিকবার তাঁকে ঘুম থেকে তোলার প্রচেষ্টাও হয়েছিল নানাভাবে। তবে সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয়নি। তবে কি মারা গেলেন ক্যারোলিনা? তা কীকরে হয়? দিব্যি যে হৃদস্পন্দন চলছে তার। এরপর প্রায় ছ’বছর ধরে কোনোরকমভাবে তরল খাবার খাইয়েই জিইয়ে রাখা হয়েছিল ক্যারোলিনাকে। আশ্চর্যের বিষয় হল, এই দীর্ঘ নিদ্রাকালে সেভাবে ওজন কমেনি তাঁর। শুধু দৈহিক পরিবর্তন বলতে, বন্ধ হয়ে গিয়েছিল হাত ও পায়ের নখ এবং চুলের বৃদ্ধি। 

অবশ্য এতকিছুর পরেও দারিদ্রের কারণে বড়ো কোনো চিকিৎসকের কাছে ক্যারোলিনাকে নিয়ে যেতে পারেনি ওলসন পরিবার। তার জন্য অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ ছ’বছর। ১৮৮২ সালে অস্কারশামন শহরের এক হাসপাতালে ঘুমন্ত অবস্থাতেই নিয়ে যাওয়া হয় ক্যারোলিনাকে। সেখানে বিভিন্ন পরীক্ষানিরীক্ষা করে দেখা হয় তাঁর শারীরিক অবস্থা। ইলেকট্রোশক থেরাপি, অ্যাড্রিনালিন-সহ একাধিক পদ্ধতিতেই তাঁর ঘুম ভাঙানোর চেষ্টা করেছিলেন চিকিৎসকরা। এমনকি তাঁর এই আশ্চর্য শারীরিক দশার কারণে বসাতে হয়েছিল আস্ত একটি মেডিক্যাল বোর্ডও। তবে সাফল্য মেলেনি কোনো। দীর্ঘ একমাস পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল হাসপাতাল থেকে। রিপোর্টে জানানো হয়েছিল, ডিমেনশিয়া প্যারালাইটিকায় আক্রান্ত হয়েছেন ক্যারোলিনা। অর্থাৎ ঘুমের মধ্যেই তিনি আক্রান্ত হয়েছেন পক্ষাঘাতে। যতদিন বেঁচে থাকবেন তিনি, এভাবেই বেঁচে থাকতে হবে তাকে। 

অবশ্য চিকিৎসকদের এই ভবিষ্যদ্বাণী ভুল বলে প্রমাণিত হয় আরও ২৬ বছর পর। ১৯০৮ সালের ৫ এপ্রিল সকালে অলৌকিকভাবেই ঘুম থেকে জেগে ওঠেন ক্যারোলিনা। তখন তাঁর বয়স ৪৬ বছর। তবে শারীরিক বৃদ্ধি হলেও, তাঁর জীবন থেকে স্রেফ বাদ চলে যায় তিন দশক সময়। তখনও তাঁর মনে ১৪ বছর বয়সি কিশোরীর মানসিকতা। বদলে যাওয়া চারপাশ দেখে নিজেও প্রাথমিকভাবে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে গোটা বিষয়টাই পরিষ্কার হয় তাঁর সামনে।

অন্যদিকে ক্যারোলিনার ঘুম ভাঙার কথা ছড়িয়ে পড়তেই রীতিমতো সাড়া পড়ে যায় চিকিৎসক মহলে। শুরু হয় নানান গবেষণা। কীভাবে হঠাৎ রোগমুক্তি হল তাঁর? আকস্মিক ‘কোমা’ থেকে ফিরে এলেন কীভাবে তিনি? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে লড়াই চালিয়েছেন বহু গবেষকই। তবে সুস্পষ্ট উত্তর মেলেনি কোনো। আর ক্যারোলিনা?

১৯০৮ সালে ঘুম ভাঙার পর বাকি জীবন দিব্যি সুস্থ-সবলভাবেই কাটিয়েছেন তিনি। ১৯৫০ সালের ৫ এপ্রিল প্রয়াত হন তিনি। উল্লেখ্য, এই একই তারিখে দীর্ঘ ৩২ বছরের ঘুম ভেঙেছিল তাঁর। এও এক অদ্ভুত সমাপতন। তবে মজার বিষয় হল, এত কিছুর পরেও গিনেস বুকের পাতায় ‘দীর্ঘতম ঘুম’-এর রেকর্ড রয়েছে অন্য এক মহিলার কাছে। তিনি অ্যালেন স্যান্ডলার। অ্যালেন ১১ বছর টানা ঘুমিয়েছিলেন। অবশ্য তাঁর ক্ষেত্রে সেই ঘুম ছিল পারতপক্ষে স্বাভাবিক। অর্থাৎ, আঘাত পাওয়ার জন্য পক্ষাঘাত বা কোনো জটিল রোগে আক্রান্ত হননি অ্যালেন। তাই তাঁর ঘুমকেই দীর্ঘতম ঘুমের স্বীকৃতি দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা। তবে ক্যারোলিনার নাম গিনেস বুকের পাতায় খুঁজে না-পাওয়া গেলেও, তাঁর এই ‘ঘুম’ এক ঐতিহাসিক মাইলফলক হয়েই রয়ে গেছে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে। 

Powered by Froala Editor