বাঙালির প্রাণাধিক প্রিয় জিলিপির ইতিহাস কিন্তু লুকিয়ে বিদেশেই

বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। আর সেই পার্বণের ভিড়ে তৈরি হয় এক একটি মেলা। ছোটো ছোটো তাঁবু খাটিয়ে মাঠে হাজির হয় বিক্রেতারা। উনুন থেকে ধোঁয়া ওঠে; আর একটু একটু করে বাড়তে থাকে ভিড়। আমাদের সবার কাছেই এ অতি পরিচিত দৃশ্য। তবে রথের মেলা হোক বা পৌষ পার্বণ— মেলার মাঠে ঢুকে বাঙালির খোঁজ চলে কিছু বিশেষ দোকানের দিকে। সার দিয়ে বসে আছে ময়রার দল; আর গরম গরম তেলে তৈরি হচ্ছে আড়াই প্যাঁচের ‘জাদু’। রস থেকে পাতে উঠে এলেই ষোলোকলা পূর্ণ! জিলিপির সঙ্গে আমাদের যে একেবারে আত্মার সম্পর্ক… 

অবশ্য শুধু মেলা বা বিশেষ উৎসব উপলক্ষেই নয়। ভোরবেলায় সূর্যের আলো গায়ে নিয়ে গরম গরম কচুরি, তরকারি আর গরম জিলিপির স্বাদ— আহা! যেন অমৃত! জিলিপির খ্যাতি আজ বাংলায় তো বটেই, গোটা ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। এক এক জায়গায় হয়ত এক এক রকম নাম। কিন্তু বস্তুটি একই। আজ আমরা এত একাত্ম হয়ে গেছি এই পদটির সঙ্গে, যে বেশিরভাগ সময় ভুলেই যাই এর আসল উৎসের কথা। বাংলা-সহ ভারতের অন্যতম প্রধান মিষ্টি হওয়া সত্ত্বেও জিলিপি কিন্তু ‘ভারতীয়’ নয়! তাহলে?

এর জন্য সীমানা পেরিয়ে যেতে হবে অন্য একটি দেশে। সেইসঙ্গে সঙ্গী হবে ইতিহাস। শুরু করা যাক একটি বই দিয়ে; নাম ‘কিতাব-উল-তাবিখ’। পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই রান্নার বইটি লেখা হয়েছিল দশম শতকের শুরুতে। এই বইতেই পারস্যের এক ব্যক্তি মুহম্মদ বিন হাসান আল-বাগদাদী উল্লেখ করেন একটি বিশেষ পদের। নাম ‘জুলবিয়া’। প্রায় একই সময় সায়ার অল-ওয়ারাকের লেখা একটি আরবের রান্নার বইতেও এই নামটি পাওয়া যায়। জুলবিয়ার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য এই দুটি বই থেকেই জানতে পারেন ঐতিহাসিকরা। এখন প্রশ্ন, এর সঙ্গে আজকের লেখার কী সম্পর্ক? এই জুলবিয়াই পরবর্তীকালে ভারতে এসে বদলে যায় ‘জালেবি’ বা বাংলায় ‘জিলিপি’-তে। 

ইরানে গেলে আজও দোকানে জুলবিয়ার দেখা পাওয়া যায়। খানিক চেখেও দেখতে পারেন। বিশেষ করে পার্সিদের নববর্ষের দিন এই মিষ্টির পদটি প্রায় সব ঘরেই তৈরি করা হয়। অবশ্য কেবল নামেই নয়, চেহারাতেও জিলিপির সঙ্গে কিছু পার্থক্য দেখতে পাওয়া যায়। জুলবিয়া আড়াই প্যাঁচের নয়; বরং খানিক ফুলের চেহারা পেয়েছে। এবার ইরান থেকে আরেকটু মধ্যপ্রাচ্যে সরে এলে জুলবিয়া বদলে যাবে ‘জালাবিয়া’-তে। সাধারণত চিনির রসে কিছুক্ষণ ডুবিয়ে রাখার পর জিলিপি পরিবেশন করা হয়। মধ্যপ্রাচ্যের জালাবিয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা একটু অন্য। সেখানে চিনির রসের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় মধু ও গোলাপ-জল। 

মধ্যযুগে ব্যবসা সূত্রে যখন মধ্যপ্রাচ্য, পারস্য (ইরান) থেকে মানুষেরা ভারতে প্রবেশ করতে লাগল, তখন তাঁদের সঙ্গে ওই দেশের সংস্কৃতি, খাবারও ঢুকতে শুরু করে। সেই দলে যোগ দেয় জুলবিয়া বা জালাবিয়াও। মোটামুটি পনেরো শতকের শেষের দিকে ভারতে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে যায় এই খাদ্যদ্রব্যটি। ১৪৫০ সনে জিনাসুরার লেখা জৈন গ্রন্থ ‘প্রিয়মকর্ণপকথ’-এ প্রথমবার ভারতের জিলিপির উল্লেখ পাওয়া যায়। তখন অবশ্য এর নাম ছিল ‘জলভাল্লিকা’ বা ‘কুণ্ডলিকা’। পরবর্তীতে বেশ কিছু সংস্কৃত গ্রন্থে (‘গুণাগুণবোধিনী’, ‘ভোজন কুতূহল’ ইত্যাদি বই) এখনকার জিলিপি এবং তার তৈরির পদ্ধতি পাওয়া যায়। উৎসবে, অনুষ্ঠানে তো বটেই; মন্দিরের প্রসাদ হিসেবেও এর চল শুরু হয়। 

যত দিন গেছে, জিলিপি ভারতের প্রতিটি কোণায় ছড়িয়ে পড়েছে। তার রূপ অনেক, নামও অনেক। উত্তর ভারতে যেখানে ‘জালেবি’ প্রচলিত, সেখানে দক্ষিণ ভারত ব্যবহার করে ‘জিলেবি’। বাংলার জিলিপি কখনও হয়ে যায় ‘ছানার জিলিপি’, মধ্যপ্রদেশে হয়ে যায় ‘মাওয়া জালেবি’। আর অন্ধ্রপ্রদেশে এসে নাম আর রূপ বদলে হয়ে যায় ‘ইমারতি’, যাকে বাংলায় ‘অমৃতি’ বলে ডাকা হয়। উল্লেখ্য, এই ইমারতি স্বয়ং মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের অত্যন্ত পছন্দের মিষ্টি ছিল বলে এর আরেকটা নাম হয়ে যায় ‘জাহাঙ্গিরি’! 

এ তো গেল ইতিহাসের কথা। কিন্তু তাতেই কি আর সব গল্প থেমে যায়! বাংলা তো বটেই, ভারতের গলি গলিতে ঘুরলে এরকম আরও কত গল্প পাওয়া যাবে জিলিপিকে ঘিরে। কত সংসারের দিনযাপন, কত মানুষের স্মৃতি, নস্টালজিয়া মিলেমিশে গেছে এই মিষ্টির সঙ্গে। বিদেশে থাকা মানুষটির হয়ত মাঝে মাঝে মন আনচান করে উঠবে এর জন্য। বা রথ এলে যে ছেলেটা রাস্তায় ছুটে যেত পাঁপড়ভাজা আর জিলিপি খেতে, আজ শরীর ও কাজের চাপে সেই ক্ষমতা হারিয়েছে। কিন্তু স্মৃতিগুলো তো গায়ে লেগে আছে! জন্ম হোক না বিদেশে, তাতে কি! দিনের শেষে জিলিপি যে আমার আপনার আপনজন… 

তথ্যসূত্র - The Journey of Jalebi Doesn’t Begin in India. We Reveal Its Sweet Story!, Sayantani Nath, The Better India

Powered by Froala Editor

More From Author See More