জাপানে পা রাখা প্রথম ‘বাঙালি বউ’ যোগ দিয়েছিলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীতেও

১৯১২ সালের ৫ নভেম্বর, কলকাতা বন্দর থেকে একটি জাহাজ ভেসে পড়ল সমুদ্রের বুকে। গন্তব্য জাপান। ডেকে দাঁড়িয়ে এক অভূতপূর্ব জুটি। স্বামী-স্ত্রী। সদ্য আর্থিক মন্দার মুখে পড়া, ঢাকায় এক সাবান কারখানার মালিক, জাপানি উয়েমন তাকেদা। সঙ্গে তাঁর অর্ধাঙ্গিনী হরিপ্রভা মল্লিক। ঠিকই পড়ছেন, জাপানি বাবুটির বাঙালি বউ।

এই দাম্পত্যটি নেহাত সাধারণ ছিল না। বাংলা থেকে জাপানে ‘স্ত্রী’ হয়ে পাড়ি জমানো প্রথম মহিলা হরিপ্রভাই। ১৯০৭ সালে মাতৃনিকেতনের সেবিকা হরিপ্রভা নববিধান ব্রাহ্মমতে বিবাহ করেন স্নেহের ‘তাকেদা সান’-কে। ব্যবসায় আর্থিক ক্ষতি হওয়ায়, পত্রপাঠ তা গুটিয়ে নিয়ে ১৯১২ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা থেকে তাকেদা দম্পতি রওয়ানা হন সূর্যোদয়ের দেশে।

প্রথম জাপানসফরের বিবরণ পুঙ্খানুপুঙ্খ খুঁটিয়ে লিখেছেন হরিপ্রভা। বাদ যায়নি ইতিহাস-আচার-আদবকায়দা-রীতিনীতি। প্রথম প্রথম আধসেদ্ধ জাপানি খাবার মুখে রোচেনি বঙ্গনারীর। “ভাত সিদ্ধ করিয়া আহার করিতেন” হরিপ্রভা। এর আগে ‘ভারতীয় মহিলা’ দেখেনি জাপানি সমাজ। অতএব, হরিপ্রভার কথা ছড়িয়ে পড়েছে দেশে। ফলে রাস্তায় বেরোলেই, “ইন্দোজিন দেখিবার নিমিত্ত” ভিড় বেড়েই যেত। ধীরে ধীরে তাঁর, ‘সরলস্বভাবা’ শ্বাশুড়িকে ভালোবেসে ফেলেন হরিপ্রভা। তাই পরে ভারতে প্রত্যাবর্তনের সময় আর চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি তিনি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পাকাপাকি ভাবে জাপানে চলে আসেন তাকেদা দম্পতি। প্রবল অর্থসংকটে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র এবং রাসবিহারী বসু। এর পরের বছর আজাদ হিন্দ ফৌজের হয়ে, রেডিও টোকিওয়ে সংবাদ পাঠিকার চাকরি নেন হরিপ্রভা। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও তাঁর জড়িয়ে পড়া এভাবেই। দেশভাগের পর জলপাইগুড়ির বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।

১৯১৫ সালে প্রকাশিত হয়েছিল হরিপ্রভার প্রথম বই ‘বঙ্গমহিলার জাপান যাত্রা’। রবীন্দ্রনাথের ‘জাপানযাত্রীর ডায়েরী’র-ও আগে। প্রথম কোনো বাঙালি তথা ভারতীয় মহিলা হিসেবেই জাপানে পা রেখেছিলেন হরিপ্রভা।