মাটির হাঁড়িতে ঢাকা মুখ, পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিনব প্রতিবাদ ‘প্রিন্সেস পি’র

বেশ কয়েক বছর আগের কথা। দিল্লির প্রগতি ময়দান চত্বরে আয়োজিত হয়েছিল ইন্ডিয়া আর্ট সামিট। নানা রাজ্য থেকে নানা বয়সের দর্শকরা ভিড় জমিয়েছিলেন সেখানে। ছবি বা স্থাপত্য ছাড়াও নানা ধরনের শিল্পকলার পাশাপাশি সেই আয়োজনে অন্যতম আকর্ষণ হয়ে উঠেছিলেন এক শিল্পী নিজেই। বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়েছিল। সাধারণ পোশাকের সঙ্গে তাঁর বিশেষত্ব ছিল মাথা ঢাকা একটি মাটির হাঁড়ি। মাথা ঢাকা থাকার কারণে নিজে দেখতে পাচ্ছিলেন না কিছুই। তবে কয়েকজন সহকারী তাঁর হাত ধরে মেলায় ঘুরছিলেন। আর দর্শকরাও একবার হাত মেলাতে চাইছিলেন শিল্পীর সঙ্গে। কিন্তু কে এই শিল্পী? অনুষ্ঠানে নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন ‘প্রিন্সেস পি’, অর্থাৎ রাজকুমারী মটরদানা। তাঁর মাথা ঢাকা হাঁড়িটিকে একটি বড়ো মটরদানা হিসাবেই কল্পনা করে নিতে বলেছিলেন তিনি। কিন্তু নিজের প্রকৃত পরিচয় জানাননি সেদিন।

২০০৯ সালের এই মেলার পর থেকে প্রিন্সেস পি-এর কথা ছড়িয়ে পড়তে থাকে নানাভাবে। পরে জানা যায়, তিনি গুরগাঁও শহর নিবাসী একজন চিত্রশিল্পী। দিল্লির কলেজ অফ আর্ট থেকে পড়াশোনা করেছেন। এর চেয়ে বেশি কিছুই জানা যায় না তাঁর সম্পর্কে। তবে ১০ বছর পর ২০১৯ সালে এক অন্য ভূমিকায় দেখা যায় প্রিন্সেস পি-কে। মাথায় মাটির হাঁড়ি আগের মতোই রয়েছে। তবে এবার একটি দূরদর্শন অনুষ্ঠানে তিনি হাজির হয়েছেন মহিলাদের মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে সচেতনতা তৈরি করতে। অনুষ্ঠানের দর্শক সমস্ত মহিলাকে তিনি অনুরোধ করেন, তাঁদের নিজের জীবনের কিছু কথা তাঁরা মানুষের সামনে তুলে ধরুন। অবশ্য কারোরই পরিচয় প্রকাশ করা হবে না বলেও জানান তিনি। বিভিন্ন রাজ্য থেকে চিঠি আসতে থাকে সেই অনুষ্ঠানে। তবে প্রথমদিকে দেখা যায়, প্রায় সমস্ত মহিলাদের চিঠির বিষয়বস্তু জুড়েই রয়েছে কেবল তাঁর পরিবার। ব্যক্তি নারীর অস্তিত্বই সেখানে অনুপস্থিত। আর এই সমস্যাটির দিকেই দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছিলেন প্রিন্সেস পি।

এরপর চিঠি সংগ্রহের পাশাপাশি বিভিন্ন মহিলাদের বাড়িতে পৌঁছে তাঁদের নিয়ে ভিডিও তৈরির কাজও শুরু করেন তিনি। তবে সেখানে সেই মহিলারাও তাঁর মতোই মাটির হাঁড়িতে মাথা ঢেকে নিয়েছেন। নিজেদের পরিচয় গোপন রাখারই একটি কৌশল এটি। কিন্তু কেন এভাবে পরিচয় গোপন রাখা? তাও পরিষ্কার করে দিয়েছেন অজ্ঞাতনামা এই শিল্পী। আসলে আমাদের সমাজ তো নারীর কথা শুনতেই চায় না। তাই এখানে প্রতিটা কথাই একজন নারীর কথা, এটুকুই যথেষ্ট। সেই নারীর ব্যক্তি পরিচয়ের কোনো মূল্য নেই। সমাজ যদি নারীকে তাঁর ব্যক্তিসত্তার মূল্য দিতে শেখে, তখন সেই সত্তা প্রকাশ করার প্রয়োজন থাকে। 

করোনা অতিমারীর মধ্যেও থেমে থাকেনি প্রিন্সেস পি-এর কাজ। মহিলাদের বাড়িতে বাড়িতে নানা রঙের মাটির হাঁড়ি পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। আর সেই হাঁড়িতে মাথা ঢেকে মহিলারা নিজেরাই ভিডিও করে পাঠিয়েছেন। কোথাও কোথাও আবার একসঙ্গে জুড়ে থাকা দুটি হাঁড়ির মধ্যে মাথা গলিয়ে দিয়েছেন দুজন নারী। বোঝাতে চেয়েছেন, আলাদা মানুষ হলেও তাঁদের গল্পগুলো কোথাও গিয়ে একই। আসলে এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে প্রত্যেক নারীর গল্পই আসলে সমস্ত নারীর গল্প। শৈল্পিক এই প্রতিবাদের ভিতর দিয়ে সেই বার্তাই দিতে চান প্রিন্সেস পি।

Powered by Froala Editor