পর্তুগীজ নারীর প্রভাবে ধর্মান্তরিত হতে চেয়েছিলেন খোদ মোঘল সম্রাটও!

পুরনো দিল্লির শহরতলিতে ছোট্ট অঞ্চল ওখলা। সেখানে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ চোখে পড়তে পারে একটি ফলক। তাতে লেখা রয়েছে ‘সরাই জুলেনা গাঁও’। এটুকুই। পান্থশালাটির কোনো অস্তিত্ব আর নেই। মোঘল আমলের সেই স্থাপত্য ভেঙে ফেলে উঠেছে বহুতল আবাসন। তেমনই ইতিহাস থেকে হারিয়ে গিয়েছে জুলেনা, অর্থাৎ জুলিয়ানা দিয়াস দা কোস্টার নামও। তবে একসময় মোঘল রাজসভায় রীতিমতো সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হত তাঁর নাম। পর্তুগীজ খ্রিস্টান পরিবারের মেয়ে হয়েও মোঘল রাজপরিবারের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তিনি। খোদ দারাশিকোর প্রাসাদে থাকতেন জুলিয়ানা। পরে তাঁর জন্যই তৈরি হয়েছিল বেশ কয়েকটা বিলাসবহুল প্রাসাদ। কিন্তু কে এই জুলিয়ানা? ইতিহাস খুঁড়ে অবশ্য খুব কম তথ্যই জানা যায়।

জুলিয়ানার পরিচয় নিয়ে ঐতিহাসিকরা আজও একমত হতে পারেননি। অনেকের মতে, পর্তুগিজ উপনিবেশ হুগলি শহর আক্রমণ করে যে বন্দিদের নিয়ে গিয়েছিলেন সম্রাট শাজাহান, তাঁদের মধ্যেই কোনো একটি পরিবারে জন্ম জুলিয়ানার। আবার কেউ বলেন, কোচিন বন্দর পর্তুগীজদের হাত থেকে ডাচরা দখল করে নিলে যে পরিবারগুলি সম্রাট ঔরঙ্গজেবের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল, জুলিয়ানার জন্ম সেখানে। অবশ্য আধুনিক কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন, জুলিয়ানা ছিলেন একজন পর্তুগিজ চিকিৎসকের স্ত্রী। অসুস্থ ঔরঙ্গজেবের চিকিৎসার জন্য ডেকে আনা হয়েছিল সেই সাহেবকে। আর সেই সূত্রেই জুলিয়ানার সঙ্গে মোঘল দরবারের পরিচয়।

তবে প্রত্যেকেই একটি বিষয়ে একমত, জুলিয়ানা একটি অত্যন্ত শিক্ষিত পরিবারের সন্তান ছিলেন। তিনি নিজেও ছিলেন একজন বিদূষী নারী। নানা বিষয়ে তাঁর পাণ্ডিত্য মুগ্ধ করেছিল সম্রাট ঔরঙ্গজেবকেও। আর তাই নিজের দুই পুত্রের শিক্ষার দায়িত্ব জুলিয়ানার কাঁধেই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি। এই সুযোগটারই সদ্ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন জুলিয়ানা। তিনি লক্ষ করেছিলেন, শাজাহান ও দারাশিকোকে বন্দি করে যেভাবে অত্যাচার করেছিলেন ঔরঙ্গজেব, তা মেনে নিতে পারেননি শাহজাদা মুয়াজ্জেম। এরপর মুয়াজ্জেমের মনের মধ্যে একটু একটু করে ঔরঙ্গজেব এবং ইসলাম সম্বন্ধে ঘৃণার বীজ বপন করতে থাকেন জুলিয়ানা। শোনা যায় মুয়াজ্জেম নাকি খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করতেও রাজি হয়ে যান। তবে এর মধ্যেই ঔরঙ্গজেব তাঁর বড়ো ছেলেকেও বন্দি করে জেলখানায় পাঠান।

মুয়াজ্জেমকে খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী করা আর সম্ভব হয়নি। কিন্তু তার জন্য মুয়াজ্জেমের প্রতি আনুগত্য কমেনি জুলিয়ানার। ১৭০০ সাল থেকে ১৭০৭ সাল পর্যন্ত কারাবন্দি মুয়াজ্জেমকে খাবার-দাবার থেকে শুরু করে নানাকিছু গোপনে সরবরাহ করতে থাকেন তিনি। এমনকি রাজকর্মচারীদের মধ্যে শাহজাদার প্রতি সহানুভূতি জাগিয়ে তোলার কাজও করতে থাকেন। আর কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে মুয়াজ্জেমও তাঁর কৃতজ্ঞতায় কার্পণ্য করেননি। ১৭০৭ সালে প্রথম বাহাদুর শাহ নাম নিয়ে সিংহাসনে বসেন মুয়াজ্জেম। আর তখন থেকেই মোঘল দরবারে জুলিয়ানার প্রতিটা কথাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রথমে দারাশিকোর প্রাসাদটি জুলিয়ানার জন্য ছেড়ে দেন প্রথম বাহাদুর শাহ। এরপর জুলিয়ানার জন্য একাধিক বিলাসবহুল প্রাসাদও তৈরি করে দেওয়া হয়। ওখলা অঞ্চলে তখনই গড়ে উঠেছিল সেই পান্থশালা।

১৭১২ সালে প্রথম বাহাদুর শাহের মৃত্যু হয়। তবে জুলিয়ানার প্রতিপত্তিতে হাত দেননি পরবর্তী শাসকরাও। ঠিক কতদিন তিনি বেঁচেছিলেন, তা জানা যায় না। তবে শেষ পর্যন্ত যে মোঘল দরবারে তাঁর নাম সম্ভ্রমের সঙ্গে উচ্চারিত হত, তাতে সন্দেহ নেই। হয়তো জুলিয়ানার সূত্র ধরে পর্তুগিজ ঔপনিবেশিকদের সঙ্গেও মোঘল শাসকদের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হয়েছিল। মোঘল দরবারে জেসুইট প্রতিনিধির সংখ্যা তো নেহাৎ কম ছিল না। তবে আশ্চর্যজনকভাবে কয়েক জায়গায় জুলিয়ানার নাম উল্লেখ ছাড়া আর কোনো তথ্যই পাওয়া যায় না পর্তুগিজ নথি থেকে। ইতিহাসের গর্ভে এমন অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। শুধু কিছু সূত্র ফেলে রেখে যায় পিছনে।

Powered by Froala Editor

More From Author See More