১৪৩ বছর আগে ফরাসি ভাষায় সাহিত্যচর্চা বাঙালি তরুণীর, অকালপ্রয়াণে থেমেছিল সব

১২, রমেশ দত্ত স্ট্রিট। অতীতে এর পরিচয় ছিল ১২, মানিকতলা স্ট্রিট হিসেবে। এই ঠিকানাতেই আছে একটি বাড়ি। আজ থেকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় আগে এই জায়গাটি আরও বড় ছিল। ছিল বিশাল পুকুর, চৌবাচ্চা, বাগান। আর ছিল একটি মেয়ে। খুব বেশি বয়স হবে না তার। সারাদিন ধরে কী যে ভাবত! হয় লাইব্রেরি, নয়ত নিজের ঘরের নিরালা কোণে। কখনও ইংরেজিতে, কখনও ফরাসিতে লিখে যেত একের পর এক কবিতা। সেই কবিতার সাক্ষী ছিল তার বোন। একদিন সেও চলে গেল। কিন্তু ছোট্ট সেই মেয়েটির লেখার ছোঁয়া পেয়েছিল গোটা পৃথিবী। আফসোস, রমেশ দত্ত স্ট্রিটের বাড়িটা ওর স্পর্শ পেল না বেশিদিন। সাহিত্য জগতও হারাল আরেক ‘একুশি’-কে। তরু দত্তের জীবনটাই যে ছিল এরকম, মৃত্যু ছুঁয়ে ছুঁয়ে বেড়ে ওঠার…

আরও পড়ুন
রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে একই বছরে জন্ম, বিস্মৃতির অতলে ঐতিহাসিক অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

তখন তিনি বিদেশে। দেশে ফেরা নিয়ে তরু একটি চিঠিতে লিখছেন, “হয়ত কোনো একদিন ফিরব। হয়ত আর কোনদিনই ফেরা হবে না।” এই দোলাচল সবসময়ই ছিল তাঁর জীবনে। ছিল দত্ত পরিবারেও। অত্যন্ত বিখ্যাত ছিল এই পরিবার। ১২, মানিকতলা স্ট্রিটের বর্তমান পরিচিতি যার নামে, সেই ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র দত্তও ছিলেন এই পরিবারেরই একজন। এদেরই একজন, রসময় দত্ত ছিলেন কলকাতার ছোট আদালতের প্রথম বাঙালি জজ। তরু দত্তের বাবা গোবিন্দ দত্তও ছিলেন সেই সময়ের প্রসিদ্ধ একজন ব্যক্তিত্ব। পরে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। তাঁরই ঘরে জন্ম নেয় তিন সন্তান— ছেলে অবজু ও দুই মেয়ে অরু ও তরু।

আরও পড়ুন
প্রশ্নেই রয়েছে গলদ, আচার্য সুনীতিকুমারের ভুল ধরিয়ে দিলেন ছাত্র সুকুমার সেন

কিন্তু ভাগ্য বড় জটিল জিনিস। এর অভিঘাত যখন আসে, তখন যে সব ছারখার করে দিয়ে যায়। এটাই কি মনে হয়েছিল ছোট্ট তরু’র? মাত্র ১৪ বছর বয়সে অবজু মারা যায়। এরপরই দত্ত পরিবার পাড়ি দেন বিদেশে। উপস্থিত হন ফ্রান্সের নিসে। অবশ্য তার আগেই কিশোরী তরু’র মধ্যে সাহিত্য, শব্দের রস ঢুকে গেছে। বিদেশে গিয়ে যেন আরও মেলে ধরলেন নিজেকে। ইংরেজি আর ফরাসি ভাষার মধ্যেই পেয়েছিলেন নিজের মুক্তি। নিজের গল্পে, কবিতায় সেগুলি তুলে ধরতে লাগলেন তরু। ১৮৭৬ সালে প্রকাশিত হল প্রথম বই, ‘আ শিফ গ্লিনড ইন ফ্রান্স ফিল্ড’। বিভিন্ন ফরাসি কবিতার ইংরেজি অনুবাদে সমৃদ্ধ এই বই। উল্লেখ্য, এই বইটিই তরু দত্তের জীবদ্দশায় প্রকাশিত একমাত্র বই। ফরাসি ভাষায় লেখা বইটির অনুবাদ করেছিলেন তারই দিদি, অরু দত্ত। দুই বোনের প্রতিভার প্রকাশ তুখন থেকেই শুরু। দুজনেই লেখে, গান গায়, সেইসঙ্গে চলতে থাকে পড়াশোনা।

আরও পড়ুন
থই পাননি আবিষ্কারকও, ১১৭ বছরের ধাঁধার সমাধান করেছিলেন এক ভারতীয়

১৮৭৩ সালে সপরিবারে দত্তবাড়ি ফিরে আসেন তাঁরা। ততদিনে অবশ্য ইংরেজ সমালোচক এডমন্ড গস এবং ফরাসি সমালোচক আন্দ্রে থ্যুরিয়েঁ-র প্রশংসা আদায় করে নিয়েছিলেন তরু দত্ত। শুধু কবিতা বা গল্প নয়, ভারতের পুরাণের বিভিন্ন কাহিনিও ইংরেজিতে অনুবাদ করেন তিনি। তার মধ্যে ছিল সাবিত্রীর উপাখ্যান, ধ্রুবোপাখ্যান, রাজর্ষি ভরতের কাহিনি উল্লেখযোগ্য। রিচার্ড গার্নেট সম্পাদিত ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ক্লাসিকস’-এ তাঁর কয়েকটি কবিতাও ছাপা হয়। আস্তে আস্তে ভারত ও বাংলার জগতেই নয়, বিশ্বের মঞ্চেও ছড়িয়ে পড়ছিলেন সদ্য যৌবনে পা দেওয়া মেয়েটি। এমন সময়, জীবনে ফিরে এল মৃত্যু। ১৮৭৪-এ ২৩ বছর বয়সে চলে গেলেন প্রিয় সাথী, প্রিয় দিদি অরু দত্ত। দুজনে মিলে ঠিক করেছিলেন ফরাসিতে একটি উপন্যাস লিখবেন; আর সেটার ছবি আঁকবে অরু। সেসব আর হল না। পড়াশোনার মধ্যেই ঢুকে গেলেন তরু। ভেতরে ভেতরে কি ভাঙছিলেন তখনই? নয়তো অরু চলে যাওয়ার তিন বছর পরই, ১৮৭৭ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সেই কেন তাঁরও প্রস্থান? যক্ষ্মা এভাবে কেন শেষ করল একটি প্রতিভাকে…

আরও পড়ুন
শান্তিনিকেতনে পড়াতে ডাকলেন রবীন্দ্রনাথ, সঙ্গে-সঙ্গে চাকরিতে ইস্তফা লীলার

উত্তর পাওয়া যায়নি। তিনটি ফুটফুটে, প্রতিভাশালী সন্তানের এরকম অকালে চলে যাওয়া মানতে পারেননি দত্ত দম্পতিও। তরুর মৃত্যুর পর এক এক করে পাণ্ডুলিপি খুঁজে পান তাঁর বাবা গোবিন্দ দত্ত। মৃত্যুর পরই প্রকাশ পেতে থাকে তাঁর সেই কাজগুলো। তরু’র প্রথম ইংরেজি উপন্যাস ‘বিয়াঙ্কা’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ সালে, বেঙ্গল ম্যাগাজিনে। কোনো ভারতীয় মহিলার লেখা প্রথম ইংরেজি উপন্যাস। ফরাসি উপন্যাসও ভারতে তিনিই প্রথম লিখেছিলেন। অন্যান্য বইগুলোও এই সময়ই পরপর বের হয়। তাঁর সব লেখায় যেমন ছিল ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের ছবি, সেই সময়ের কথা; তেমনই ছিল বাংলা। ‘Ancient Ballads and Legends of Hindustan’ বইটি সেই ভারতীয় ঐতিহ্যেরই বাহক। সবই হল, প্রকাশ পেল। বিশ্বে ছড়িয়েও পড়ল। কিন্তু সেসবের সাক্ষী থাকতে পারলেন না তরু দত্ত।

আরও পড়ুন
১৭৫ বছর আগে, ডাক্তারি পড়তে বিলেত পাড়ি দিয়েছিলেন এই ‘দজ্জাল’ বাঙালি

এ যেন হওয়ারই ছিল। বাংলা সাহিত্য এরপরও আরও এক স্বল্পায়ু কবিকে পাবে (সুকান্ত ভট্টাচার্য)। বাংলাকে বিশ্বের দরবারে নিয়ে যাওয়ার কাজটি যেটা করে গিয়েছিলেন তরু দত্ত, সেটা অস্বীকার করা যায় না। পুরুষদের মধ্যে মাইকেল যে কাজটি করেছিলেন, নারী হিসেবে সেটাই করেছিলেন তরু দত্ত। বিদেশি ভাষায় প্রথম রচয়িতা ছিলেন যে তিনি। মানিকতলা খ্রিস্টান গোরস্থানে শুয়ে, ২১ বছরের এক তরুণী কি এখনও ভেবে চলেছেন জীবনের কথা? ভেবে চলেছেন সেই শেষ না হওয়া ফরাসি উপন্যাসের কথা? উত্তর হয়তো লুকিয়ে আছে পুরনো মাটির ভেতর; আর ১২, রমেশ দত্ত স্ট্রিটের ওই বাড়িটায়…

ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘তরুলতার পাতা পাঠালাম…’
২) জীবনী কোষ
৩) Scroll.in

More From Author See More