এক বছরে পাঁচ মহাদেশের সমুদ্র সাঁতরে বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন এই বাঙালি

১৯৬৬ সালের ৩১শে অক্টোবর। পানামা খালের দিকে নজর গোটা বিশ্বের। প্রশান্ত ও আটলান্টিক মহাসাগরকে যুক্ত করেছে যে খাল, সেখানে ঘটছে একটি বিশেষ ঘটনা। একজন অ-আমেরিকান লোক সাঁতরে পানামা খাল পার হচ্ছেন। প্রায় দুদিন ধরে চেষ্টা করছেন তিনি। পারবেন কি?

হ্যাঁ, পারলেন তিনি। ৩৪ ঘণ্টা ১৫ মিনিটের একনিষ্ঠ চেষ্টায় পার করলেন এই খাল। এই প্রথম কোনও অ-আমেরিকান ব্যক্তি পুরো পানামা খাল অতিক্রম করলেন। তবে শুধু পানামাই নয়, আরও অনেক কীর্তি যে জুড়ে আছে তাঁর নামের সঙ্গে। সবথেকে বড় কথা, এতক্ষণ ধরে আমাদের আলোচনার মধ্যমণি যিনি, তিনি একজন বাঙালি। তিনি আর কেউ নন, বাংলার কিংবদন্তি সাঁতারু মিহির সেন।

এতগুলো রেকর্ড যার নামের সঙ্গে, তাঁর জীবনটাও একটা অ্যাডভেঞ্চারের থেকে কম নয়। ১৯৩০ সালে পুরুলিয়ায় জন্মেছিলেন মিহির সেন। বাবা রমেশ সেনগুপ্ত ছিলেন একজন ডাক্তার। মিহিরবাবুর যখন আট বছর বয়স, তখন সপরিবারে তাঁরা চলে আসেন কটকে। মূল উদ্দেশ্য ছিল ছোট্ট মিহিরের আরও ভাল পড়াশোনার। সেখানেই নিজের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকেন তিনি। ভুবনেশ্বরের উৎকল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন নিয়ে স্নাতক হওয়ার পর, ইংল্যান্ডে যাওয়ার ভাবনা ঘুরতে থাকে মিহিরের মাথায়। কিন্তু টাকা তো নেই! সেই সময় ওড়িশার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বিজু পত্তনায়েকের সহায়তায় তিনি লন্ডন যাত্রা করেন। তখন কে জানত, এখান থেকেই শুরু হবে একটা ইতিহাস?

ইংল্যান্ডে থাকতে থাকতেই তিনি পরিচিত হন ফ্লোরেন্স চ্যাডউইকের গল্পের সঙ্গে। উল্লেখ্য, ফ্লোরেন্স প্রথম আমেরিকান মহিলা যিনি বিখ্যাত ইংলিশ চ্যানেল পার করেছিলেন। ওনার কাহিনিই উজ্জীবিত করে মিহির সেনকে। সাঁতারে কিছু করতে হবে, এই লক্ষ্যে শুরু হয় ট্রেনিং। দিনের পর দিন কঠোর প্রশিক্ষণের পর, নিজেকে দক্ষ করে তুললেন তিনি। তারপর প্রস্তুতি নিলেন ইংলিশ চ্যানেল জয়ের।

সাফল্য অবশ্য একবারে আসেনি। কিন্তু হেরে যাওয়া সত্ত্বেও, হার মানেননি মিহির। অবশেষে, ১৯৫৮ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ইংলিশ চ্যানেল জয় করেন তিনি। সময় লেগেছিল ১৪ ঘণ্টা ৪৫ মিনিট। তিনিই প্রথম ভারতীয় যিনি ইংলিশ চ্যানেল জিতেছিলেন। আর এই কৃতিত্বই ১৯৫৯ সালে তাঁকে এনে দেয় ‘পদ্মশ্রী’ সম্মান। অবশ্য এতেই থেমে থাকেননি এই কিংবদন্তি সাঁতারু। ১৯৬৬ সালেই তিনি এক বছরেই পাঁচ মহাদেশের সমুদ্র পার করেন। বিশ্বে তাঁর আগে আর কেউ এই কৃতিত্ব রাখেনি। আর এখানেই তিনি জয় করেন পানামা খাল। দিনটা ছিল ৩১ অক্টোবর। সম্পূর্ণ করেন তাঁর যাত্রা। যেটা গিনেস বুকে চিরকালের জন্য থেকে যায়। ১৯৬৭ সালে যার জন্য পান ‘পদ্মভূষণ’ সম্মান।

এই কৃতিত্ব যার, তাঁর শেষ বয়সটা কেটেছিল চরম দুর্ভোগে। তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে তাঁর মতানৈক্য হয় এবং যার দরুন তাঁকে নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। একসময় অসুস্থ হয়ে পড়েন এই কিংবদন্তি। স্মৃতি ক্রমশ লোপ পেতে থাকে। ধরা পড়ে পারকিনসন’স ডিজিজ। এই সবকিছু মিলিয়ে রোগের থাবা জাঁকিয়ে বসে দেহে। ১৯৯৭ সালে, মাত্র ৬৬ বছর বয়সেই চলে যান মিহির সেন। তিনি চলে গেলেও, তাঁর কৃতিত্ব অক্ষুণ্ণ থেকে গেছে আজও। গিনেস রেকর্ড আজও কেউ ভাঙতে পারেনি। বাংলার অন্যতম প্রবাদপ্রতিম ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব হয়ে থেকে গেছেন ইতিহাসে।

More From Author See More