ঔপনিবেশিক স্মৃতি মুছে ‘আফ্রিকার ভাষা’ সোয়াহিলি

পরিসংখ্যান বলে, পৃথিবীতে প্রতি দুই সপ্তাহে অন্তত একটি করে ভাষার মৃত্যু ঘটছে। আর ভাষার এই অবক্ষয়ের পিছনে দায়ী মূলত ঔপনিবেশিকতা। ইউরোপীয় ভাষাগুলো আজও গিলে খাচ্ছে বহু ভাষাকে। কিন্তু এর মধ্যেও ভাষা হয়ে উঠছে মানুষের জাতিসত্ত্বার প্রতীক। নিজস্ব সংস্কৃতির মূলে ফিরতে নিজেদের ভাষার কাছেই ফিরছেন অনেকে। এভাবেই আফ্রিকাজুড়ে বাড়ছে সোয়াহিলি ভাষার ব্যবহারও। এমনকি খুব তাড়াতাড়ি আফ্রিকার (Africa) বুকে সমস্ত ইউরোপীয় ভাষার সঙ্গে টেক্কা দিয়ে সোয়াহিলি (Swahili) হয়ে উঠতে পারে গোটা মহাদেশের ভাষা। এমনটাই মনে করছেন অনেকে।

উপনিবেশ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকেই আফ্রিকায় শুরু হয়েছিল নিজস্ব সংস্কৃতির অনুসন্ধান। আর একের পর এক দেশ স্বাধীনতা পাওয়ার পর সেই অনুসন্ধান আরও গতি পায়। আর এই সময় থেকেই উঠে আসতে থাকে সোয়াহিলি ভাষাও। যদিও সোয়াহিলি ভাষা তার জন্মলগ্নে খুব বেশি বিস্তার লাভ করতে পারেনি। মূলত আরব বণিকদের নিয়ে আসা শব্দভাণ্ডারের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছিল এই ভাষা। আজও সোয়াহিলি ভাষায় ব্যবহৃত ৪০ শতাংশ শব্দের মূলই আরবি। তবে এর পর জার্মানি এবং পর্তুগিজ ভাষারও যথেষ্ট প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এসবের পরেও সোয়াহিলির মূল সুরটি উঠে এসেছে একেবারে আফ্রিকার জনজীবন থেকেই। আফ্রিকার অন্যান্য প্রাচীন ভাষার সঙ্গেও সোয়াহিলির যথেষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। আবার বাকিদের চেয়ে সোয়াহিলি অনেকটাই আধুনিক। তাই ইংরেজি বা ফরাসি ভাষার সঙ্গে টক্কর দেওয়ার সবরকম ক্ষমতাই রয়েছে এই ভাষাটির মধ্যে।

’৬০-এর দশকে তাঞ্জানিয়ার প্রেসিডেন্ট জুলিয়াস নাইয়েরিয়ার প্রথম সোয়াহিলি ভাষাকে সম্পূর্ণ আফ্রিকার ভাষা হিসাবে ঘোষণার দাবি জানান। তাঞ্জানিয়ার রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসাবেও ঘোষণা করা হয় সোয়াহিলি ভাষাকে। তবে এখনও পর্যন্ত যে সরকারিভাবে এর ব্যবহার খুব বেড়েছে, এমনটা বলা যায় না। আফ্রিকার মোট ৫৪টি দেশের মধ্যে ২৭টি দেশেই রাষ্ট্রীয় অথবা দ্বিতীয় সরকারি ভাষা ইংরেজি। ২১টি দেশের রাষ্ট্রীয় ভাষা ফরাসি। ঔপনিবেশিকতার এই প্রভাব এখনও বয়ে বেড়াচ্ছেন আফ্রিকার মানুষ। স্কুল-কলেজে পঠনপাঠনও চলছে ইংরেজি অথবা ফরাসি ভাষাতেই। কিন্তু অবস্থার বদলও ঘটছে।

২০১৯ সালে সাউদার্ন আফ্রিকান ডেভলপমেন্ট কমিউনিটির পক্ষ থেকে সমস্ত অফিসিয়াল কাজের ভাষা হিসাবে সোয়াহিলিকেই বেছে নেওয়া হয়। আর সম্প্রতি ইস্ট আফ্রিকান কমিউনিটিও সোয়াহিলিকেই বেছে নিয়েছে অফিসিয়াল কাজকর্মের জন্য। শুধু তাই নয়, আফ্রিকান ইউনিয়নের পক্ষ থেকেও সমস্ত কাজ সোয়াহিলি ভাষাতেই করা হবে বলে জানানো হয়েছে। ফলে কঙ্গো অঞ্চলের বহু স্কুল-কলেজে শুরু হয়েছে সোয়াহিলি ভাষায় পড়াশোনা। এই পরিস্থিতিতে সোয়াহিলি সমগ্র আফ্রিকার ভাষা হয়ে উঠতে চলেছে, এমনটা বলাই যায়। তবে এখানেও কিছুটা আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে। ঔপনিবেশিক ভাষাগুলোর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতার প্রসঙ্গটি তো রয়েছেই। তাছাড়া, দক্ষিণ, পূর্ব এবং মধ্য আফ্রিকায় সোয়াহিলি ভাষা যেভাবে প্রসার লাভ করেছে, উত্তর এবং পশ্চিম আফ্রিকায় তা এখনও ঘটেনি। কারণ এই সমস্ত অঞ্চলে আরও বেশ কিছু আফ্রিকান ভাষা ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে হাউসা, ইগবো, ইয়োরুবার মতো ভাষা। সোয়াহিলি ভাষার আধিপত্য আবার এই সমস্ত ভাষাকে সংকটে ফেলবে না তো?

আরও পড়ুন
ফেব্রুয়ারি মাসেই ভাষা আন্দোলনের ডাক ঝাড়খণ্ডে

তবে এতকিছুর পরেও, জাতিপুঞ্জের মতে পৃথিবীর বৃহত্তম ১০টি ভাষার মধ্যে একটি সোয়াহিলি। ইউরোপীয়দের চোখে ‘অন্ধকার মহাদেশ’ আফ্রিকার একটি ভাষার আজ এই জায়গায় উঠে আসা সত্যিই আলাদা উল্লেখের দাবি রাখে।

আরও পড়ুন
বিলুপ্তির মুখ থেকে বাঁচাতে কারিব ভাষায় পঠনপাঠনের উদ্যোগ তরুণ-তরুণীদের

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
চলতি শতকেই হারিয়ে যেতে পারে ১৫০০ ভাষা