সংবিধানের ‘পরিপন্থী’, তাই সংবিধান থেকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিতে আবেদন সুপ্রিম কোর্টে!

সুবিশাল ভারতীয় সংবিধান সম্বন্ধে বিস্তর পড়াশোনা না করলেও, সংবিধানের প্রাথমিক ধারণাটুকু সবারই হয়তো মনে গেঁথে আছে আমাদের স্কুলের পাঠ্যবইগুলোর প্রথম পাতাটার সৌজন্যে, যেখানে বড়ো বড়ো করে লেখা থাকত ভারতীয় সংবিধানের সেই অমোঘ প্রস্তাবনা: 'আমরা, ভারতের সমস্ত নাগরিক, ভারতকে একটি সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ...'।

রাষ্ট্র হিসেবে সংবিধানের এই প্রস্তাবনা বরাবরই মেরুদণ্ডের কাজ করে এসেছে ভারতীয় সমাজে। কিন্তু এবার ভারতের সংবিধানের প্রস্তাবনা থেকে বাতিল করার দাবি উঠল এই ‘সমাজতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দদুটিই! সংবিধানের প্রস্তাবনায় ‘সোশ্যালিস্ট’ এবং ‘সেকুলার’ শব্দগুলি রাখা যাবে না, এই মর্মে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করলেন বলরাম সিং, করুনেশ কুমার শুক্লা এবং প্রবেশ কুমার নামক তিন ব্যক্তি। এদের মধ্যে বলরাম সিং ও করুণেশ কুমার পেশায় আইনজীবী।

অবশ্য এই প্রথমবার নয়, এর আগেও ২০১৬ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্টে একই দাবি নিয়ে এরকমই একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। কিন্তু তখন সেই মামলাটি গ্রহণ করেনি আদালত। কিন্তু তাহলে আবার কেন এই বিষয় নিয়ে সরাসরি সুপ্রিম কোর্টে আবেদনের প্রয়োজন পড়ল এবার? দেশের সর্বোচ্চ আদালতে দায়ের করা এই মামলায় বলা হয়েছে, ‘সমাজতান্ত্রিক’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ এই শব্দদুটি ভারতীয় ঐতিহ্যের পরিপন্থী এবং বামপন্থী ভাবধারায় অনুপ্রাণিত! নিজেদের স্বপক্ষে আরও যুক্তি দিয়েছেন মামলাকারীরা। জানিয়েছেন, এই শব্দগুলি সংবিধানের মূল সুর তথা ভারতের বহমান সুপ্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতির চিন্তাভাবনার বিরোধী।

ভারতীয় রাজনীতির ময়দানে এই বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই রয়ে গেছে ছাইচাপা আগুনের মতো। ভারতের প্রাথমিক সংবিধানে এই বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ১৯৭৬ সালে সংবিধানের ৪২তম সংশোধনী হিসেবে ২(এ) ধারা অনুযায়ী এই শব্দটি যোগ করা হয়েছিল প্রস্তাবনায়। কিন্তু এবার সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে দাবি করা হল, সংবিধানের প্রস্তাবনায় যোগ করা এই শব্দগুলি আদতে নাকি সংবিধানেরই পরিপন্থী! যুক্তি দিয়ে মামলাকারী দেখিয়েছেন, সংবিধানের দুটি অনুচ্ছেদ, ১৯(১)(এ) এবং অনুচ্ছেদ ২৫-এর পরস্পর বিরোধিতা। অর্থাৎ ১৯(১)(এ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বাকস্বাধীনতা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ২৫ অনুচ্ছেদে বর্ণিত ধর্মীয় স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে। মামলাকারীদের মতে, সংবিধানে এই শব্দদুটি যোগ করা হয়েছে কার্ল মার্ক্সের ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে প্রবাদপ্রতীম চিন্তাবিদ কাল মার্ক্স সমর্থিত সমাজতান্ত্রিক ভাবধারার কোনোদিনই কোনো মিল ছিল না বলেও দাবি করা হয়েছে এই মামলায়।

বর্তমান মামলাকারীদের যুক্তি, সুপ্রাচীন ধর্মের ভাবনাই ভারতীয় সভ্যতার মূল কাণ্ডারী। তাই ‘বিদেশি’ কমিউনিস্ট তত্ত্ব কখনোই এই সভ্যতার চালিকাশক্তি হতে পারে না। যদিও ভারতীয় প্রশাসনেও বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে সংবিধানের এই ধারা। যে কোনও রাজনৈতিক দল যখন স্বীকৃতি বা রেজিস্ট্রেশনের জন্য আবেদন করে নির্বাচন কমিশনে, তখনও এই শব্দদুটির গুরুত্ব তারা মেনে চলবে, একথা স্বীকার করতে হয় তাদেরকে। কিন্তু মামলাকারীদের দাবি, রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংস্থা এবং নাগরিকদের ক্ষেত্রেও বাদ দিতে হবে এই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ ও ‘সমাজতন্ত্রের’ মতো শব্দগুলি।

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়, গত মাসেই সিবিএসই পাঠক্রম থেকেও বাদ পড়েছিল ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র মতো বিষয়। যুক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছিল, করোনা ভাইরাসজনিত কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ছাত্র-ছাত্রীদের উপর সিলেবাসের বোঝা কমাতেই সংশোধন করা হল সিলেবাস। একাদশ শ্রেণির পলিটিক্যাল সায়েন্স পাঠক্রম থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল ‘জাতীয়তাবাদ’, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘নাগরিকত্ব’, ‘গণতন্ত্র’ এবং ‘যুক্তরাষ্ট্র কাঠামো’র মতো অংশ। স্বাভাবিকভাবেই এই পরিবর্তনেও রাজনৈতিক গন্ধ পেয়েই বিতর্ক উঠেছিল তুঙ্গে। চাপের মুখে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রককে সাফাই দিতে হয়েছিল যে, করোনা মহামারীর প্রেক্ষিতে সাময়িকভাবে বাদ দেওয়া হল এই অংশগুলি; পরবর্তীতে আবার তা সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন
অবশেষে পথে নামল পুরীর রথ, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ ঘিরে শুরু বিতর্কও

তবু প্রশ্ন রয়েই যাচ্ছে। দেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি যখন তলানিতে, প্রশ্নের মুখে কেন্দ্রের বিদেশ নীতিও, করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে বিপর্যস্ত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাও— তখন এই নিয়ে ‘হাইপ’ তোলা কি আসলে মূল বিষয়গুলি থেকে দেশবাসীর মুখ ঘুরিয়ে দেবার চেষ্টা? কেন বারবার দেখা দিচ্ছে সংবিধানের মৌলিক হাতিয়ারগুলি নিয়ে ছেলেখেলার প্রবণতা? উত্তর অধরা এখনও। তবে একের পর এক ধর্মীয় বিভেদগত পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে, কৃষক মৃত্যুর আবহে, আর্থিক কেলেঙ্কারীর দৈন্যে কিংবা অসহিষ্ণুতার প্রকাশ হিসেবে গণপিটুনিতে মৃত্যুর হেডলাইনের ভিড়ে সিলেবাস হোক কিংবা সংবিধান— সব জায়গাতেই যে এখন ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’, ‘গণতন্ত্র’ কিংবা ‘সমাজতন্ত্র’ বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়েছে, সেই ছবিটাই যেন স্পষ্ট হয়ে উঠছে দিন দিন।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ, পৃথিবীর সুদৃশ্যতম সংবিধান এঁকে দিলেন নন্দলাল বসু

More From Author See More