নিঃশ্বাসে ঝাঁঝালো গন্ধ, কাছে গেলেই জ্ঞান হারাচ্ছে সবাই; ‘দ্য টক্সিক লেডি’র কাহিনি

হাসপাতালে উপস্থিত হয়েছেন এক তরুণী রোগী। অবস্থা খারাপ; ক্যানসার হয়েছে তাঁর। তাও একদম অ্যাডভান্স স্টেজ। রোগীর প্রবল কষ্ট হচ্ছে সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তড়িঘড়ি এমারজেন্সি রুমে নিয়ে যাওয়া হল। তাঁকে ওষুধ দেওয়া হল, এবার রক্ত সংগ্রহ করা হবে। তখনই ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। রক্ত নেওয়ার সময় হঠাৎই অসুস্থ বোধ করেন মেডিক্যাল স্টাফরা। ধীরে ধীরে আরও অনেকে অসুস্থ, পরে অজ্ঞানও হয়ে গেলেন। একজন রোগীকে দেখতে গিয়ে এরকম অবস্থা? অথচ তাঁরা তো সুস্থই ছিলেন! নব্বইয়ের দশকে আমেরিকায় এমনই একটি ঘটনা সবার নজর কেড়েছিল। রাতারাতি খবরের কাগজের শিরোনামে জায়গা করে নেয় একটি বিশেষ শব্দবন্ধ - ‘দ্য টক্সিক লেডি’।

আসল নাম গ্লোরিয়া রামিরেজ। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ার বছর একত্রিশের এই মেয়েটির সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। একসময় অসুস্থ হয়ে পড়ল শরীর। পরীক্ষায় ধরা পড়ল সারভাইকাল ক্যানসার বাসা বেঁধেছে গ্লোরিয়ার দেহে। তারপরই চিকিৎসার মধ্যে দিয়েই চলছিল সবটা। কিন্তু অবস্থা তো একরকম থাকে না সবার। আরও রোগটার নাম যখন ‘ক্যানসার’। সেই বিপদে পড়লেন গ্লোরিয়া রামিরেজও।

১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪। রাতে গ্লোরিয়ার অবস্থার সাংঘাতিক অবনতি হল। দেরি না করে তাঁকে নিয়ে আসা হল দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার রিভারসাইড জেনারেল হাসপাতালে। ক্যানসারের জন্য শরীরেও অন্যান্য সমস্যা দেখা যাচ্ছিল। পালস রেট ভালো ছিল না, শ্বাস নিতেও সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। সঙ্গে সঙ্গে নিয়ে যাওয়া হল এমারজেন্সি বিভাগে। এখান থেকেই যাবতীয় ‘রহস্যের’ সূত্রপাত। প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র দেওয়ার পর ডাক্তাররা লক্ষ করেন, গ্লোরিয়ার নিঃশ্বাসের সঙ্গে অদ্ভুত একটি ঝাঁঝালো গন্ধ বেরিয়ে আসছে। এরকম তো দেখা যায় না! বুকের চামড়াও কীরকম যেন হয়ে গেছে। দেরি না করে রক্ত নেওয়া শুরু করলেন ডাক্তাররা। সেখানেও দেখলেন সমস্যা। টিউব থেকে অ্যামোনিয়ার মতো গন্ধ বেরিয়ে আসছে; উপরন্তু রক্তেও কীসব ভেসে বেড়াচ্ছে। বাকিটা পরীক্ষা করতে যাবেন, হঠাৎই ওই ঘরের তিনজন অসুস্থ হয়ে যান। কিছুক্ষণ পর, জ্ঞানও হারান। সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের বের করে নিয়ে যাওয়া হয়।

কিন্তু বিপদ আরও বাড়ে। যাঁরাই গ্লোরিয়ার কাছে আসছেন, তাঁরাই অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন! এক দুই করে সংখ্যাটা দাঁড়াল ২৩-এ। পাঁচজনকে আবার সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি করে নেওয়া হল হাসপাতালে। অবস্থা এতই গুরুতর ছিল। এদিকে গ্লোরিয়ার অবস্থাও খারাপ হচ্ছে ক্রমশ। কিন্তু কী করবেন ডাক্তাররা? যেই যাচ্ছে সে-ই তো অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছে। শেষে কিছুই করা গেল না। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার ৪৫ মিনিটের মধ্যেই মারা যান গ্লোরিয়া রামিরেজ।

এরপর শুরু হয় তদন্ত। খবরের কাগজ গ্লোরিয়ার নাম দেয় ‘টক্সিক লেডি’। ঠিক যেন এক্স-মেন সিরিজের একটি চরিত্র মনে হচ্ছে না! সত্যিই কি তাই? কয়েকদিন ধরে চলল অটোপ্সি। সমস্ত নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষায় বসলেন বিশেষজ্ঞরা। যে সব স্বাস্থ্যকর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন, তাঁদের সঙ্গেও করা বলেছিলেন। একজনের অবস্থা তো সংকটজনক হয়ে গিয়েছিল! কী করে এমন অবস্থা হল?

পরীক্ষার শেষে উঠে এল বেশ কিছু তত্ত্ব। তার মধ্যে একটি তত্ত্বকেই এখনও অবধি প্রামাণ্য হিসেবে মনে করা হয়। যদিও সেটাও অনুমানের ভিত্তিতেই বলা কিছুটা। বাড়িতে অসুস্থ হওয়ার সময় হয়ত গ্লোরিয়া রামিরেজ এমন কোনো ওষুধ খেয়েছিলেন, যার মধ্যে ডাইমিথাইল সালফক্সাইড যৌগটি ছিল। সেটাই ভেতরে বিষক্রিয়া ঘটায়। পরে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর সেটা আরও বেড়ে যায়। তারই ফলে মৃত্যু, ও এতগুলো ঘটনা।

এরকম বিয়োগান্তক মুহূর্তই বোধহয় অপেক্ষা করে ছিল গ্লোরিয়ার জন্য। মৃত্যুর প্রায় দশদিন পর, তাঁকে সমাধিস্থ করা হয় অলিভউড মেমোরিয়াল পার্কে। কমিকসের পাতা থেকে যেন বাস্তবে উঠে এসেছিল ‘টক্সিক লেডি’। দুর্ঘটনা তো বটেই, কিন্তু সেটা এতগুলো লোকের জীবনের ওপর দাঁড়িয়েছিল।

Powered by Froala Editor

More From Author See More