কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগ ছিল ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গলের, চিন্তিত দেশব্যাপী মহামারী নিয়েও

কুখ্যাত ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের পরেও, বাংলায় তথা ভারতে মহামারীর প্রকোপ বজায় ছিল দীর্ঘদিন। আর এই মহামারীর অন্যতম কারণ ছিল এশিয়াটিক কলেরা। এদেশের সাধারণ মানুষ যাকে ওলাওঠা বলতেন। ইংল্যান্ডে বসেই এই নিয়ে চিন্তিত ছিলেন একজন। তিনি ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গল। মানুষের সেবাকেই যে জীবনের মূল মন্ত্র করে নিয়েছেন তিনি। তা সে ভারতীয় না ইংরেজ, এই প্রশ্ন তাঁর কাছে বড়ো ছিল না।

ভারতের মাটিতে কোনোদিন সশরীরে উপস্থিত হননি ফ্লোরেন্স। তবে ভারতের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল দীর্ঘ। এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে সরকারি এবং বেসরকারি নানা স্তরে উদ্যোগ নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ফ্লোরেন্স। এই যোগাযোগের সূত্রপাত ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে। মহাবিদ্রোহের হাত ধরে। এর আগেই ক্রিমিয়ার যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর শুশ্রূষা করে সবার নজর কেড়েছেন ফ্লোরেন্স। ব্রিটিশ সরকার বুঝেছিলেন, একটি সুস্থ সেনাবাহিনীই তার সাফল্যের মূল সূত্র হতে চলেছে। আর এই কাজে ফ্লোরেন্সের সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

ভারতে বিদ্রোহের সময় অসুস্থ সৈন্যদের চিকিৎসার জন্য ফ্লোরেন্সের মতামত চাইলেন সরকার। তাঁর তত্ত্বাবধানেই গড়ে উঠল একটি রয়্যাল কমিশন। মহিলা হওয়ার কারণে তিনি নিজে অবশ্য এই কমিশনের সদস্য হতে পারলেন না। কিন্তু তাঁর নির্দেশেই সমস্ত কাজকর্ম চলতে লাগল। ১৮৫৮, ১৮৫৯ এবং ১৮৬২ সালে তিনটি ঐতিহাসিক প্রতিবেদন প্রকাশ করলেন রয়্যাল কমিশনের সদস্যরা। আসলে প্রতিটা প্রতিবেদন ফ্লোরেন্সের নিজের হাতে লেখা। তবে এর মধ্যেই তিনি বেশ বুঝতে পারছিলেন, দেশের সামগ্রিক জনজীবনের উন্নতি না ঘটিয়ে সৈন্যবাহিনীকেও সুস্থ করে তোলা যাবে না। ১৮৬৩ সাল থেকেই তিনি একটি বৃহৎ উদ্যোগের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। দেশজুড়ে চলতে থাকা মহামারীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্যোগ।

তখন এদেশের শাসক বড়লাট লর্ড মেয়ো। বড়লাট এবং কয়েকজন ব্রিটিশ অফিসার সাময়িক আগ্রহ দেখালেও শেষ পর্যন্ত ফ্লোরেন্স কোনো সহযোগিতা পাননি তাঁদের কাছ থেকে। কারণটা বোঝাই যায়। ফ্লোরেন্স যেভাবে এদেশের মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করার কথা বলেছিলেন, তাতে শোষণের বোঝা অনেকটাই কমাতে হত। তাছাড়া ফ্লোরেন্স জোর দিয়েছিলেন সেচ ব্যবস্থার উন্নতির বিষয়ে। অথচ খাল কেটে তেমন লাভ হয় না। বরং রেললাইন বসাতেই সরকারের আগ্রহ ছিল বেশি। ফ্লোরেন্স অবশ্য পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছিলেন, মহামারীর প্রকোপ কমাতে পারলে সরকারের খাজনার পরিমাণও অনেকটাই বাড়বে। কিন্তু সেদিকে শেষ পর্যন্ত কান দেননি কেউই।

আরও পড়ুন
জীবন্মৃত অবস্থায় কাটত দিন; ১০০ বছর আগের ‘জম্বি’ মহামারীর রহস্য মেটেনি আজও

১৮৬৭ সাল নাগাদ ফ্লোরেন্স ভাবছিলেন, এদেশের কোনো বেসরকারি উদ্যোগ বা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে মিলে যদি কাজ করা যায়। আর সেই বছরই রেভারেন্ড জেমস লং এবং মেরী কার্পেন্টার তৈরি করলেন বেঙ্গল স্যোসাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশন। আর অচিরেই লং সাহেব চিঠি লিখলেন ফ্লোরেন্সকে। এই সভার সভ্য হওয়ার আবেদন জানালেন তিনি। ফ্লোরেন্স নিজেও তো এমন একটা সুযোগই খুঁজছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সম্মতি জানিয়ে চিঠি লিখলেন লং সাহেবকে। আবার কাজ শুরু হল নতুন উদ্যোমে। লং সাহেব এবং মেরী কার্পেন্টার এদেশের অবস্থার খুঁটিনাটি লিখে জানতে লাগলেন ফ্লোরেন্সকে। আর ফ্লোরেন্স ইংল্যান্ডে বসে সেগুলো নিয়ে ভাবনা চিন্তা করতে লাগলেন। তিনিও দেশের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোকে উন্নত করার জন্য নানা নির্দেশ দিতে লাগলেন। অবশ্য এবারেও তেমন সাড়া পেলেন না ফ্লোরেন্স। তাঁর নির্দেশ মানতে গেলে সরকার অথবা জমিদারদের উপর চাপ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কিন্তু সমিতির কাজ বিচার বিশ্লেষণ করা, বিক্ষোভ দেখানো নয়। এই অজুহাতে শেষ পর্যন্ত আর কিছুই হল না। তবে মহারাষ্ট্র এবং গুজরাটে কিছু স্বেচ্ছাসেবী তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়িত করার চেষ্টা করেছিলেন।

আরও পড়ুন
মহামারী রুখেও নোবেল পাননি 'নেটিভ' উপেন্দ্রনাথ

এর মধ্যে লর্ড মেয়ো মারা গেলেন ১৮৭২ সালে। ১৮৭৮ সালে জেমস লং ইংল্যান্ডে ফিরে গেলেন। স্যোসাল সায়েন্স অ্যাসোসিয়েশনের কাজও বন্ধ হল। কিন্তু ফ্লোরেন্সের চিন্তার জগৎ থেকে ভারতবর্ষের নাম মুছে গেল না। ইংল্যান্ডের নানা সংবাদপত্রে এবং বিভিন্ন সভায় একাধিক প্রবন্ধ লিখতে লাগলেন ফ্লোরেন্স। ইলাস্ট্রেটেড লন্ডন নিউজ পত্রিকায় তাঁর লেখা প্রতিবেদন ঘিরে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছিল সাধারণ মানুষের মনে। খাল কাটা বনাম রেলপথ, এই নিয়ে জোর তর্ক চলত লন্ডনের প্রকাশ্য রাজপথে। এদেশের কৃষকদের শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজনও বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। ১৮৯৬ সাল পর্যন্ত পড়াশুনো করতে পারতেন ফ্লোরেন্স। ভারতবর্ষের কৃষকদের উন্নতির কথা ভেবে গিয়েছেন সেইদিন পর্যন্ত। তারপরেও ব্যক্তিগত সচিবের সাহায্যে এদেশের খবরাখবর নিতেন। ১৯১০ সালে তাঁর মৃত্যুর পরেও দেখা যায় ঘর ভর্তি ছড়িয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ আর পরিসংখ্যান। তার অধিকাংশই ভারতবর্ষের বিষয়ে।

আরও পড়ুন
ইহুদি-নিধন তরান্বিত করছিল মহামারী, থামালেন নাৎসি ক্যাম্পে বন্দি চিকিৎসকরাই

এখন মনে হতে পারে, ভারতবর্ষ নিয়ে তাঁর এত চিন্তার কারণ কী? পৃথিবীতে চিন্তা করার মতো তো অনেক বিষয় ছিল। আসলে যে বিরাট ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে কখনো সূর্য অস্ত যেত না, তার মুকুটের সবচেয়ে উজ্জ্বল রত্নটি ছিল ভারতবর্ষ। ফলে এদেশের খবরাখবর ইংল্যান্ডের সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছত সহজে। সরকারও অনেক বেশি সচেতন ছিল ভারতের বিষয়ে। ফলে এদেশের কৃষকদের অবস্থার কথা জানতে বেশি সময় লাগেনি তাঁর। আর তাঁর ধর্ম যে সেবার ধর্ম। মানুষের দুর্দশা তাঁকে সবসময় পীড়িত করেছে। সে মানুষ ইংরেজ হোক, বা ভারতীয়।

তথ্যসূত্র: সাবেক কলকাতার ইতিকথা, জলধর মল্লিক

Powered by Froala Editor