মহামারীতে ছারখার বাংলা, মৃত ৫০ হাজারেরও বেশি, বাদ গেল না সাহেবরাও

ব্রিটিশ সাহেবদের সাধের শহর এটি। কত অট্টালিকা, সৌধ, বিশাল প্রাসাদ, সরকারি দপ্তরে সেজে আছে চারিদিক। বাবুদের বৈঠকখানা ভরে ওঠে রাতের আলোয়। সেখানেই হঠাৎ দেখা দিল মৃত্যুর তাণ্ডব। রাজপথে, গলিতে পড়ে আছে মানুষের মতো দেখতে কিছু বস্তু। একটা সময় ওগুলো মানুষই ছিল। স্বপ্ন দেখত, কাহিনি বলত দাওয়ায় বসে। আজ আর কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। গঙ্গার ধারে পড়ে আছে শয়ে শয়ে দেহ। সৎকারের আয়োজনটুকুও নেই সেখানে। বরং শহরময় ‘স্বচ্ছন্দে’ ঘুরে বেড়াচ্ছে শকুন-হাড়গিলের দল। ঠিক এমনই চেহারা ছিল কল্লোলিনী কলকাতার। সমৃদ্ধির শহর রাতারাতি অন্ধকারে ঢেকে গেল। কারণ, মহামারি।

এইসব আজকের ঘটনা নয়। সেই প্রাচীন সময় থেকেই একের পর এক ঝড় ঝাপটা সহ্য করেছে এই শহর। দেখেছে একের পর এক মানুষ কীভাবে ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছে। তাঁর পাশের জন হয়তো আরও ঘণ্টাখানেক বাঁচবে। একবার দুবার নয়, বহুবার এই শহর আক্রান্ত হয়েছে বিভিন্ন রোগে। গোটা বাংলাই দেখেছিল মৃত্যুমিছিল। ইংরেজ আসার আগে তো বটেই, তারপরেও নানা জায়গায় মহামারির প্রকোপ দেখেছিল বাঙালি। দেখেছিল নিজের প্রিয়জনদের চলে যেতে।

পলাশির যুদ্ধের পর পাঁচ বছর কেটে গেছে। সালটা ১৭৬২। গোটা বাংলায় দেখা দিল মহামারি। ঘরে ঘরে লোক মরছে। নয় নয় করে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ মারা গেল সেবার। ঠিক আট বছর পর দেখা দিল ভয়ংকর দুর্ভিক্ষ। ইতিহাসের বইয়ের পাতায় যা ‘ছিয়াত্তরের মন্বন্তর’ নামে কুখ্যাত হয়ে রয়েছে। একে দুর্ভিক্ষ, তাতে স্রেফ ফ্যান চাওয়ার জন্য মানুষের হাহাকার। উপরন্তু আবারও ফিরে এল মহামারি; যেন দ্বিগুণ শক্তিশালী হয়ে। শুধু কলকাতাতেই মাত্র তিন মাসের মধ্যে মারা গেল ৭৬ হাজার!

তবে কেবলই বাঙালি কি? সেসময় তো ব্রিটিশরাও ভারতে ছড়িয়ে পড়েছে। হ্যাঁ, এর প্রকোপ পড়ল তাদের ওপরেও। ওই বছরেই জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৫ হাজার সাহেবও মারা গেল। তবে তাঁদের দেহও যে রাস্তায় রাস্তায় পড়েছিল, সেটা কোনো মানুষই মানবে না। তবে বাংলার গোরস্থানগুলি সেই দুঃসহ সময়ের স্মৃতি নিয়ে রয়েছে এখনও। তখন যেন ‘রাতে মশা দিনে মাছি’র শহর এক একটি রোগের কারখানা। যে ম্যালেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য হিজলি থেকে কলকাতায় আসা জোব চার্নকের, সেখানেও এই রোগের হাত থেকে রক্ষে নেই! এমনকি ব্রিটিশ সেনাদের সরাসরি নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল ‘ম্যালেরিয়ার এলাকায়’ সবসময় সতর্ক থাকতে; অফিসারদের নির্দেশ মেনে কাজ করতে। খানিক আগেই বলা হল পলাশির যুদ্ধের কথা। তবে আঠেরো শতকের প্রথম দিকের একটি পরিসংখ্যানও দুরবস্থার কথা বলছে। জ্বরের কোপে কলকাতার ১২০০ জন ইংরেজের মধ্যে ৪৬০ জন তখনই মারা যায়।

ম্যালেরিয়া তো ছিলই; সেই সঙ্গে ছিল কলেরা, প্লেগ আর কালাজ্বর। তখন সবারই সাধারণ নাম একটাই ছিল, ‘অজানা জ্বর’। সেসময়ের বিভিন্ন কাগজে তো বটেই, অনেক বইতেও এই সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ১৮২৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসের একটি প্রতিবেদনে যেমন বলা হচ্ছে- “… সম্প্রতি শহর হুগলির সামিল চুঁচড়া ও কেকসিয়ালি প্রভৃতি কয়েক গ্রামে ওলাউঠা রোগ অতিপ্রবল হইয়া বসিয়া তত্রস্থ অনেক লোককে সংহার করিয়াছেন এবং অদ্যাপিও ওই রোগে প্রতিদিন দশ বার জন শমনসদনে গমন করিতেছে তাহাকে নিবারণ করে এমত কাহার ক্ষমতা হয় না ইহা দেখিয়া ভয়ে ভীত হইয়া বিদেশী যে সকল লোক ওই সকল গ্রামে বাস করিতেছিল তাঁহারা পলায়নপর হইয়াছে এতাবন্মাত্র শুনা গিয়াছে।”

কালাজ্বরের প্রকোপে শুধু সাধারণ মানুষরাই প্রাণ হারাননি, মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছেন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও। মনে পড়ে সুকুমার রায়ের শেষ মুহূর্তের কথা? পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে মারা গিয়েছিলেন তিনি। বড়ো অসময়ের এই চলে যাওয়া বঙ্গসাহিত্যের ক্ষতি করেছিল। মৃত্যুর কারণ? সেই কালাজ্বর। প্রসঙ্গত, সুকুমারের মৃত্যুর এক বছর আগেই এই রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছিলেন ডাঃ উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। কিন্তু, এ ক্ষেত্রে তার সঠিক প্রয়োগ হল না।

এই প্রসঙ্গে চলে আসবে শমীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথাও। রবি ঠাকুরের এই সন্তানও অসময়েই চলে গিয়েছিলেন কলেরার প্রকোপে। তবে এমন অবস্থা কেন হয়েছিল তখন? বিভিন্ন জায়গায় দায়ী করা হয়েছে তখনকার পরিবেশকে। নিকাশি ব্যবস্থার দুরবস্থা, জমে থাকা ময়লা—আর সেখানেই ছিল যাবতীয় রোগের আঁতুড়ঘর। হাসপাতালের জমে থাকা জলে কিলবিল করছে মশার ডিম, লার্ভা। তার ওপর বাঙালি সমাজ গুরুতর কিছু না হলে ডাক্তারের কাছেই যেতে চায় না। ওষুধের থেকেও বেশি ভরসা পুজো-পার্বণে। সাহেবরা যখন ধনী বাড়িতে আসতেন, তখন তাঁদের চাকচিক্য দেখে মুগ্ধ তো হতেনই। তবে কেউ কেউ পেছনের অপরিচ্ছন্ন দিকটাও দেখে ফেলতেন। যেমন দেখেছিলেন বিশপ হেবরের স্ত্রী। ধনী রূপলাল মল্লিকের বাড়ি গান শুনতে গিয়ে মশার কামড়ে টিকতে পারেননি। পরে এই নিয়ে রীতিমতো অভিযোগও জানান।

এসবের জন্যই একের পর এক মৃত্যু দেখত কলকাতা। উনবিংশ-বিংশ শতকেও বহুবার প্লেগ, কলেরার সংক্রমণ ছড়িয়েছে শহরে। ছড়িয়েছে ভারতেও। উনবিংশ শতকের শেষের দিকে কলকাতার প্লেগে আর্তের সেবার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা-সহ রামকৃষ্ণ মিশনের গুরুভাইরা। কিন্তু সচেতনতা কি বেড়েছিল? এখান থেকেই পরে রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেন রোনাল্ড রস, উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারীরা। কিন্তু তার প্রয়োগ সাধারণ সমাজে কি হয়েছিল সেভাবে? হলেও, সময় লেগে গিয়েছিল অনেকটা। যার ফল, এই হাজার হাজার মানুষের মৃত্যুমিছিল।

ঋণ-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘মহামারীর মহানগরী’
২) কলিকাতা সেকালের ও একালের, হরিসাধন মুখোপাধ্যায়
৩) সেকালের সংবাদপত্রে কলকাতা, হরিপদ ভৌমিক সম্পাদিত

Powered by Froala Editor

More From Author See More