পুজো শেষ হলেই মা দুগগা আসেন ঢাকিদের বাড়ি

'ঢাকি ঢাক বাজিয়ে পায় না লুচি'- একথা শুনে আসছি সেই ছোটবেলা থেকে। ঢাকিজীবনে  অভাব অনাহারের মাঝে উৎসবের  ওই মহার্ঘ্য  লুচিগুলোই যেন আমাদের কাছে অমৃত। সারাটা বছর অন্যের জমি ঠিকাভাগে চাষ করা আর সন্ধের অবসরে ঢাকের পিঠে কাঠি দিয়ে বাজিয়ে যেন শরীরে প্রশান্তি আসে। লোকে বলে বারোমাসে তেরো পার্বণ, কিন্তু ঢাকিদের তেমন চাহিদা কই? আজকাল তো আবার কোলকেতার বাবুরা প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ঢাকের আওয়াজ বাজায় মাইকে। বলি তাতে কি মা দুগগা খুশি হচ্ছে?  খুশি হয়ে তেনাদের আশীর্বাদ করছেন?  

আমি ভুবন দাস। আমি এমনই সাতপাঁচ ভেবেই যাচ্ছি সেই সকাল থেকে। বিড়ি খেয়েও আজ কিছুতেই মন বসছে না কাজে। কাজ বলতে আর কী! ওই বসে বসে দড়ি পাকানো! বাড়ির ছাগলটাকে পগবিলের মাঠে বেঁধে দেওয়া ঘাস খাওয়ানোর জন্য। এই কার্তিক মাসে আর কাজ কই হাতে! সেই তো পাড়ার সকলে ট্রেন ধরে গেলাম কোলকেতাতে ঢাক বাজাতে। সে কি তোড়জোড় সবার! মহালয়া দিন ভোরে শহরে গেলাম  ঢাকের নতুন চামড়া লাগাতে। তারপর সারাদিন অল্প চপ-মুড়ি খেয়ে সেই রাতের শেষ ট্রেনে ফিরলাম সবাই মিলে। তারপর টানা তিন-চারদিন কত বাজানোর তালিম হল।  বিপিন, সুধা, সার্থকের তখন চোখে থাকত না ঘুম। শুধু কলকেতার বাবুদের কাছে সেরা ঢাকি হতে সকাল থেকে সন্ধে কত রকম যে বাজনার নকশা করত তার ঠিক নেই।

দেখতে দেখতে চতুর্থী পেরিয়ে পঞ্চমীও চলে এল। মিত্তিরবাড়ি দুগগা প্রতিমাকে রাঙিয়ে দিতে নলিয়াপুর থেকে ভৈরব পাল ও তাঁর ছেলেরা এসে গেল। আমাদের ঝোলা গোছানোও হয়ে গেছে। ঝোলাতে ঢাকে পরিয়েছি নতুন কাপড়। সবাই ধরবো সকালের ট্রেন। সবাই বলতে আমি, বিপিন, সুধা, সার্থক ও সবার ছেলে আর ভাইপোদেরও কোমর বেঁধেছে।  কোলকেতা গিয়ে তারা বাবা কাকাদের সাথে ঢাকের তালে তালে কাঁসি বাজাবে। ইস্টেশনের রাস্তায় যেতে যেতে সবাই ঢাক কাঁধে নিয়ে চলেছে মিছিলের মতো। একটুখানি অপেক্ষার পর ট্রেনও ঢুকে গেল। এই ট্রেন আমাদের নিয়ে যাবে কোলকেতাতে। আমাদের মতো অন্য ইস্টেশন থেকেও কত কত ঢাকি উঠল। তারাও যাবে কোলকেতাতে বাজাতে। দেখতে ব্যান্ডেল ছাড়িয়ে নৈহাটি ইস্টেশন এল। নৈহাটি ছাড়িয়ে ট্রেন কত কত ইস্টেশন পার হল আর ট্রেনটাও ভিড়ে ভরে উঠল। তারপর একসময় ট্রেন এসে থাকল শিয়ালদে ইস্টেশনে।

চারদিকে কত কত লোক রে! আমি বললাম সুধাকে। সুধা উত্তর দিল, বোধহয় দুগগা পুজো বলে শিয়ালদেতে মেলা বসেছে, তাই এত ভিড়!  আমি আর কোনও উত্তর না দিয়ে ভিড় ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে গেলাম সদর ফটকের দিকে। বের হয়ে দেখি এ তো মহাকাণ্ড! চারদিকে কত কত লোক, কত ঢাকি ঢাক কাঁধে ঢুকছে। কত জন রঙ্গ করে ঢাক বাজাচ্ছে, তার পাশে ছোট ছেলেরা কাঁসি বাজাচ্ছে। কত রংবেরঙের ঢাক, তার কত কত বাহার। দেখেই তাক লেগে যাচ্ছে। যে যাই হোক, আমাদেরকেও দেখাতে হবে আমরা কত বড় ঢাক বাজিয়ে, তাই আমরা সবাই একটা জায়গা দেখে বসে ঝোলা থেকে মুড়ি, লাড়ু আর মুড়কি খেয়ে লাগলাম বাজাতে। সে কত রকমের বাজনা, কত তার অঙ্গ! কত লোক হাঁ করে দেখছে আমাদের দিকে। আমাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের ছেলে-ভাইপোগুলোও বাজিয়ে যাচ্ছে কাঁসি।

একটু অপেক্ষা করতে করতেই কোথা থেকে একটা গাড়ি করে একদল লোক আমাদের বায়না করার জন্য, তারপর দরদাম করে আমাদের তারা নিয়ে চলে গেল অনেক দূরের একটা জায়গায়। যেতে যেতে দেখলাম কত আলো, কত প্যান্ডেল, কত রকমের দুগ্গা, ঠাকুর। তারপর একটা মস্ত বড় প্যান্ডেলের সামনে গাড়িটা থামল। আমাদের গাড়ি থেকে নামতে বলা হল। আমরাও যে যার ঢাক, ঝোলা, কাঁসি নিয়ে মোটা আটজন হাজির হলাম। কী সোন্দর আর বড়ো প্যান্ডেল গো! দেখেই তাক লেগে যায়। আমরা পাঁচদিন এখানেই বাজনা বাজাব। ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী করে দশমীদিন বির্সজনের বাজনা বাজিয়ে তবেই বিদায় হবে আমাদের। ঠিক যেন মা দুগগার মতো।

কমিটির ছেলেগুলো প্যান্ডেলের পেছনের বিছানা দিয়েছে আমাদের থাকার। কত রকমের খাবার দিচ্ছে। আহা রে আমাদের মেয়েটা, বৌটা, তোরা যদি এমন খাবার সোওয়াদ পেতিস! তবু ভালো আমার সঙ্গে আমার ছেলেটা এসেছে। রমরম করে ঢাক আর কাঁসি বাজিয়ে ভালো বকসিসও হচ্ছে, সাথে আগাম বায়নার টাকাও পাওয়া গ্যাছে। তবে আমার চেয়ে সুধার বকসিস হয়েছে কারণ ওর বাজনা বাবুরা খুব পছন্দ করেছে।

দেখতে দেখতে দশমীও পার হয়ে গেল। বিসর্জনে ঢাকের তালে কত কত মেয়েও নাচল আমার সামনে, তার ঠিক নেই। রাতেকমিটির হেড বাবুলদা আমার হাতে আরও একশ টাকা গুঁজে দিয়ে বলল ছেলেমেয়ের জন্য এটা দিয়ে মিষ্টি কিনে যাবে। আমার চোখে জল চলে এল। মনে পড়ল গত বারের কথা। চন্দননগরের মালবাবুদের বাড়িতে যেচ্ছিলাম ঢাকি হয়ে। বায়না ছাড়া বকসিস তো দেয়ইনি, তার উপর আবার পুলিশের ভয় দেখিয়েছিল আমাকে। 

একাদশীর দিন ভোর উঠে যাওয়া শেয়ালদেতে, কমিটির ছেলেরাই গাড়ি করে বলেছিল ছেড়ে আসবে। ভোর ট্রেন ধরে যেতে যেতে ভেবেছি কত কথা। পাঁচুন্দির হাতে একটা ছাগল কিনতে হবে, আমার মেয়ে বুলবুলির জন্য একটা জামা কিনতে হবে, ঘরটা মেরামতও করতে হবে। কিন্তু এইটুকু টাকা দিয়ে হবে কী! জানি না। উত্তর নেই। তবে পুজো পেরিয়ে গেলেও বুলবুলির জন্য টিপের একটা পাতা, চুড়ি আর একটা লাল রঙের জামা কিনে নিয়ে যেতে হবে। বৌয়ের জন্য না হয় পরের বার হবে শাড়ি। আর বাড়িতে নিয়ে যাব অচিন্তর দোকান থেকে মুরগির মাংস। দুপুরে সবাই মিলে একসাথে খেতে বসা যাবে। ছোটোবেলাতে দাদু বলত আমাকে, ওরে মুচিদের বাড়ির মা দুগগা পুজোর পরেই এসে দেখা দেন। কথাটার মানে তখন বুঝিনি। আজ বুঝেছি তার মানে। হ্যাঁ। আজ বুঝেছি ঠিকই।

More From Author See More