অ্যাপেলের 'কামড়'-এর নেপথ্যে কে?

সাদা ক্যানভাসের ওপরে পড়েছে নিটোল একটি আপেলের ছায়া। তবে চাঁদের কলঙ্কের মতোই তার গায়ে জেগে আছে কামড়ের দাগ। আজকের দিনে দাঁড়িয়ে এই অতি-সাধারণ ছবিই যে সর্বোচ্চ মানের গ্রাহক নিরাপত্তা এবং আভিজাত্যের প্রতীক, তা নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু এমন একটি বিশ্বমানের সংস্থার লোগোয় আধখাওয়া আপেল (Apple)! কোনো না কোনো সময়ে, এই প্রশ্ন জেগেছে সকলের মনেই। নিজের স্বপ্নের সংস্থার লোগো-তে কেন ‘খুঁত’ রেখেছিলেন স্টিভ জোবস (Steve Jobs)?

না, আপেলের এই আধখাওয়া প্রতিকৃতির পিছনে স্টিভ জোবসের ভূমিকা নেই খুব একটা। রয়েছেন অন্য একজন মানুষ। সেটাই আলোচ্য বিষয়। তবে তার আগেও একটু কথা বলে নেওয়া ‘অ্যাপেল’ নামটি নিয়েও। এত নাম থাকতে শেষে কম্পিউটারের নাম আপেল! এই প্রসঙ্গে ইন্টারনেট সার্চ করলেই ভুরি ভুরি তত্ত্ব হাজির হবে সামনে। তবে ‘অ্যাপেল’ নাম রাখার কারণটি আদতেও অত জটিল নয়। স্টিভ জোবসের প্রিয় ফল ছিল আপেল। সেইসঙ্গে নিজের সংস্থা তৈরি আগে একটি আপেল বাগান পরিদর্শনে গিয়েছিলেন জোবস। সেখান থেকেই তাঁর মাথায় পরিকল্পনা আসে, এই নামেই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন তিনি। কারণ, নামটির মধ্যে শুধু সারল্যই নয় রয়েছে হালকা মজাও।

১৯৭৬ সালে সেই মতোই স্টিভ উজনিয়াক এবং রোনাল্ড ওয়েইনের সঙ্গে জুটি বেঁধে তৈরি তিনি তৈরি করে ফেললেন ‘অ্যাপেল কম্পিউটার’। সংস্থা তো প্রতিষ্ঠিত হল। কিন্তু লোগো? সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এসেছিলেন সংস্থার তৃতীয় প্রতিষ্ঠাতা রোনাল্ডই। ছোটোবেলা থেকে অল্প-বিস্তর আঁকাআঁকি করেছেন তিনি। ফলে, লোগো তৈরির দায়িত্বটাও তিনি তুলে নিলেন নিজের কাঁধে। 

গাছের নিচে বসে এক মনে বই পড়ছেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। আর গাছের ওপর থেকে একটি আপেল খসে পড়ছে তাঁর মাথায়। উপরে ও নিচে বড়ো বড়ো হরফে লেখা ‘অ্যাপেল কম্পিউটার.কো’।

আরও পড়ুন
অলস মস্তিষ্কেই আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কার আইনস্টাইনের, সুফল পেয়েছিলেন স্টিভ জোবসও!

হ্যাঁ, এটাই ছিল আপেলের প্রথম লোগো। তবে জোবস বা উজনিয়াক কারোরই পছন্দ হয়নি এই লোগো। কারণ, ছবিতে লেখা ও পরিপার্শ্বিক ছবির থেকে আপেলটা এতটাই ছোটো যে ছিল, সেটা গৌণ হয়ে গিয়েছিল। তবে প্রাথমিকভাবে বছর খানেক এই লোগোই ব্যবহার করেছিল অ্যাপেল। 

আরও পড়ুন
জার্মান কোড সমাধান করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে চার বছর কমিয়ে দেন এই গণিতবিদ

তবে বছর খানেকের মধ্যে ব্যবসা খানিকটা দাঁড়ানোর পর, নতুন লোগো তৈরির জন্য মাঠে নামেন জোবস। ততদিনে অর্থের অভাবে কোম্পানি ছেড়েছেন রোনাল্ড। হিসেব মতো মাত্র ১২ দিন তিনি কাজ করেছিলেন এই সংস্থায়। যাই হোক, নতুন লোগোর জন্য স্টিভ জোবস হাজির হয়েছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক বিজ্ঞাপনী সংস্থার কাছে। সেই সংস্থাই এই দায়িত্ব অর্পণ করেন গ্রাফিক ডিজাইনার রব জ্যানোফকে। স্টিভ জোবসের দাবি ছিল একটাই। সুন্দর নয়, এই লোগোকে হতে হবে সরল। জ্যানোফকে ডেকে একান্তভাবে জোবস জানিয়েছিলেন, ‘জাস্ট ডোন্ট মেক ইট কিউট’।

আরও পড়ুন
কম্পিউটার মাউসের সহ-স্রষ্টা তিনি, নীরবেই চলে গেলেন কিংবদন্তি ইঞ্জিনিয়ার বিল ইংলিশ

সেই সারল্যের অনুসন্ধানেই সাদা ক্যানভাসের ওপরে কালো আপেল এঁকেছিলেন জ্যানোফ। এমনকি রাখেননি ‘অ্যাপেল’ নামটাও। কারণ, তৎকালীন সময়ে অ্যাপেলের প্রতিদ্বন্দ্বী আইবিএম বা অন্যান্য সংস্থারা নামের ওপরেই জোর দিচ্ছে লোগোর ক্ষেত্রে। তবে সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। প্রাথমিকভাবে সন্তুষ্ট হলেও, পরে নিজেই নিজের আঁকা ছবি দেখে ঘাবড়ে যান জ্যানোফ। স্ট্রবেরি ও চেরির প্রতিকৃতিও যে অনেকটাই আপেলের মতোই! তবে? প্রথমে পাতা সংযোজন করে সেই সমস্যার সমাধানের চেষ্টা করেন তিনি। তবে তাও পছন্দ হয় না নিজের। শেষে অন্যান্য ফলের থেকে পৃথক করতে নির্দিষ্ট অনুপাতে কামড়ের দাগ বসান আপেলের গায়ে। 

বলাই বাহুল্য, এই ছবি একবারেই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল স্টিভ জোবসের। শুধু সারল্যই নয়, এমন ছবিই যেন প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছিল সহজলভ্যতারও। সে-সময় আইবিএম বা অন্যান্য কম্পিউটারের দাম ১৬০০ ডলার থেকে শুরু হলেও, অ্যাপেলের দাম ছিল মাত্র ১২০০-১৩০০ ডলারের মধ্যে। ফলে, লোগো নিয়ে কোনো অভিযোগই ছিল না সংস্থার দুই প্রতিষ্ঠাতার। শুধু কালোর বদলে আপেলটির গায়ে ৬টি রঙের প্রলেপ দিতে বলেন তিনি। কারণ, সেই বাজারে আপেলই ছিল একমাত্র সংস্থা যারা রঙিন ডিসপ্লের কম্পিউটার প্রদান করত গ্রাহকদের। 

হ্যাঁ, আজ যে লোগো আমরা দেখি, তা আকারে না বদলালেও, বদলেছে তার রং। প্রথম দেড় দশকেরও বেশি সময় ছ-রঙা লোগোই ব্যবহার করেছিল অ্যাপেল। 

ওয়াল্টার আইজ্যাকসনের লেখা স্টিভ জোবসের জীবনী ‘স্টিভ জোবস’-এও উল্লেখিত হয়েছে এই ঘটনা। তবে লোগো তৈরি এই বিস্তারিত কাহিনি পরবর্তীতে প্রকাশ্যে আনেন স্বয়ং লোগো ডিজাইনার রব জ্যানোফ। এমনকি এই লোগো-বৃত্তান্ত নিয়ে আস্ত একটি গ্রন্থও লিখেছেন তিনি। ‘টেকিং এ বাইট আউট অফ দ্য অ্যাপেল’। মজার বিষয় হল, এই লোগো তৈরির সময় তিনিও কি জানতেন একসময় বার্কলির এই ছোট্ট সংস্থাই রাজত্ব করবে প্রযুক্তির দুনিয়ায়?

Powered by Froala Editor

More From Author See More