ঘরের যুদ্ধ সামলে বাইরেও সেরা, পাঁচ বিশিষ্ট নারীর 'আগল ভাঙার' গল্প উঠে এল ট্রাইব ক্যাফেতে

নারীদিবস নয়, প্রতিটি দিনই হোক মনুষ্যত্বের উদযাপন। যে যুদ্ধটা শুরু হয়েছিল ঘরে, সেটা পেরিয়ে বাইরেও জিতে নেওয়ার গল্প বললেন সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত পাঁচজন বিশিষ্ট নারী। আড্ডা জমেছিল বালিগঞ্জের ট্রাইব ক্যাফেতে। আড্ডার নামটি ভারি চমৎকার, 'স্পিরিট আনব্রিডলড'। উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় নাট্যকর্মী তথা অভিনেত্রী রমণজিৎ কৌর, সাহিত্যিক সমাজকর্মী সায়রা শাহ হালিম, ছিলেন মিসেস ইন্টারন্যাশনাল সমাজকর্মী চৈতালী দাস, শিল্পী পারমিতা ব্যানার্জী এবং বিজনেস কনসালটেন্ট তথা লেখক ঈপ্সিতা গাঙ্গুলি।

আরও পড়ুন
স্বনির্ভরতাই যথেষ্ট নয়, উদ্যোগপতি হয়ে উঠুক গ্রামের মেয়েরা – অন্যরকম লড়াই শিবানীর

জীবন যেন এক অদ্ভুত যাত্রা। যেখানে প্রতিটা বাঁকেই রয়েছে চমক। রয়েছে হেরে যাওয়া,ভয়; আবার সেসব কাটিয়ে বেঁচে ওঠার লড়াই। ট্রাইবের এই অনুষ্ঠানেও সেই লড়াইয়ের কথাই ফুটে উঠল। জীবনের টার্নিং পয়েন্ট সম্পর্কে বলতে গিয়ে প্রত্যেকেই প্রায় আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠেন। ঈপ্সিতা যেমন বললেন, "আমি একটা সময় কথাই বলতাম না। সেই আমি থেকে আজকে কোম্পানির সেলস ডিপার্টমেন্টের হেড হয়ে ওঠাটাকেই টার্নিং পয়েন্ট মনে হয়।" বিলাসবহুল জীবন থেকে নেমে এসে মাঠে ঘাটে কাজ করা— প্রাথমিকভাবে ভয়েরই ছিল। কিন্তু, জীবনই যে শিখিয়ে দিয়েছে ভয়কে জয় করে এগিয়ে যাওয়ার মন্ত্র। সিনসিয়ারিটি, প্যাশন আর দুশ্চিন্তামুক্ত 'বিন্দাস' চরিত্রই সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করেছেন ঈপ্সিতা।

আরও পড়ুন
‘ছেলে থাকলে উপার্জন আসত সংসারে’, অভাবী মায়ের ভুল ভাঙছেন ২১ বছরের বাঙালিনী

চৈতালীর কাছে লড়াইটা আবার রক্ষণশীল বাড়ির গণ্ডি পেরিয়ে এসে একজন সমাজকর্মী হয়ে ওঠা। তারপর সমাজকর্মীদের তথাকথিত ইমেজ ভেঙে মিসেস ইন্টারন্যাশনাল হয়ে ওঠা। সেই যাত্রাটা যদিও খুব সহজ ছিলনা। সেই যাত্রার নস্টালজিয়াও উঠে এলো তাঁর কথায়। সেই সঙ্গে উঠে এল পাট নিয়ে তাঁর কাজের কথা। তিনি একজন প্রতিষ্ঠিত সোশ্যাল অন্ত্রেপ্রেনর। এমএসএমই'র সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁর সংস্থা কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের বহু কাজ করেন। এছাড়াও কাজ করেছেন প্রেসিডেন্সি এবং দমদম সংশোধনাগারে। রমণজিৎ তুলে ধরলেন তাঁর বিস্তৃত অভিনয় জীবনের কথা। থিয়েটার, সিনেমার এই যাত্রা যেন নিজেকেই চিনতে চিনতে এগোনো। সেনা পরিবারের সন্তান সায়রা শাহ হালিম নিজের বাবার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন যুদ্ধের সময়। সেখানেও ভয়, এই যদি খারাপ খবর আসে! সেখান থেকে এমন একটি পরিবারের গৃহিণী হয়ে আসা, যারা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে এক উল্লেখযোগ্য নাম। সায়রা'র শ্বশুর যে ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার স্পিকার, হাসিম আব্দুল হালিম। এই পরিবারের শিক্ষা, চর্চা, লিবারেল পরিবেশ— সবকিছুই যেন জড়িয়ে ধরেছে তাঁকে। তিনিও এগুলো নিয়েই বেড়ে উঠেছেন। আজ তিনি এত পরিচিত মুখ, সাহিত্য সভাতেও তাঁর উপস্থিতি অন্য জায়গায়।

আরও পড়ুন
ধর্মের ভিতর থেকে গোঁড়ামির বিরোধিতা, শাহিনা জাভেদ এক অন্যস্বরের নাম

সমগ্র অনুষ্ঠানটিকেই একটি সুরে বেঁধে দিয়েছিলেন পারমিতা। তাঁর কথাতেই উঠে এল একটা অমোঘ সত্য। জীবনে চলার পথে, না বলতে শেখাটা ভীষণ জরুরি। বললেন, নিজের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণটাই হল আসল কথা। চায়ের দোকান চালানো মহিলাটি থেকে হোমমেকার, কর্পোরেটরা সকলেই কতখানি সফল, তার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা শোনা গেল তাঁর গলায়।

আরও পড়ুন
জাতিভেদের বিরুদ্ধে লড়াই, ‘অস্ত্র’ মেয়েদের ফুটবল ক্লাবও – দিনবদলের স্বপ্ন বুনছেন প্রতিমা

তবে প্রত্যেকের কথাতেই একটা ঘটনা উঠে এল। আমাদের সবারই কিছু মানবিক গুণ আছে। কিছু সৃষ্টিশীলতা আছে, বেড়ে ওঠা আছে। এই অনুভূতিগুলো কর্পোরেট ইদুর দৌড়ের মধ্যে কোথায় যেন হারিয়ে যায়। সেটাও একটা ভয়ই বটে! তার সঙ্গেও পাল্লা দিয়ে লড়তে হয়। এখানেই উঠে আসে 'চয়েসের' প্রসঙ্গ। আমরা কী চাই, মন থেকে সেটার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ, কমফোর্ট জোনও আদতে একটি আনকমফোর্ট পরিস্থিতি। ভেতর থেকে ডাক আসবেই। সেইদিকে এগিয়ে যাওয়ার কথাই আলোচনার অন্যতম অংশ হয়ে উঠল। যেমন, ড্রাইভিং। একটা সময় মেয়েদের গাড়ি চালানোকে খানিক আড়চোখেই দেখা হত। সেখান থেকে আজ বদল হয়েছে অনেকটা। চৈতালী দাসও বলছিলেন নিজের অভিজ্ঞতার কথা।

আরও পড়ুন
সমাজ ‘মাতৃতান্ত্রিক’, দৈনন্দিন ছবি ঠিক তার বিপরীত – কেমন আছেন ঝাড়খণ্ডের আদিবাসী নারীরা?

দর্শকরাও সমানতালে অংশ নিলেন আলোচনায়।
ষাটোর্ধ্বা এক প্রৌঢ়া বললেন তাঁর ড্রাইভিংয়ের গল্প। কীভাবে সমাজের চোখরাঙানিকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ৪৫ বছর ধরে নিজেই নিজের গাড়ি চালাচ্ছেন। পাশে পেয়েছিলেন নিজের বাবা, এবং স্বামীকে। খানিকটা কৌতুক করেই বললেন, স্বামীর চেয়েও দক্ষ ড্রাইভার তিনি!

আরও পড়ুন
ট্রাকের গায়ে ফুটে উঠছে নারীমুক্তির স্বপ্ন, রং-তুলিতেই ‘স্বাধীনতা’র খোঁজ পাকিস্তানে

সব মিলিয়ে, আগামীর কাছে এক স্বপ্নের সন্ধান দিয়ে গেলেন তাঁরা। জুগিয়ে গেলেন স্বপ্ন দেখার সাহস এবং সমাজের প্রচলিত ধ্যানধারণা ভেঙে নিজের ওপর আস্থা রাখার বার্তা। শুধুমাত্র নারীত্ব নয়, মনুষ্যত্বেই রইল তাঁদের আস্থা। অনুষ্ঠান শেষ হল পারমিতার খোলা গলায় খোলা হাওয়ার উদাত্ত রবীন্দ্র সঙ্গীতে। সেখানেও ছড়িয়ে ছিল মুক্তির গন্ধ।

আরও পড়ুন
লিঙ্গ সমতার শিক্ষা পাক ছোটরাও, পাঠ্যপুস্তকে নারী-অগ্রগতির ছবি মহারাষ্ট্রে

সত্যিই, সমাজের পালে এমনই খোলা হাওয়া এসে লাগুক। তরতরিয়ে এগিয়ে চলুক আগামীর নৌকা, আর এমনই সব ছকভাঙার গল্প আমাদের দিয়ে যাক বেঁচে থাকার রসদ।