প্রয়াত প্রবীণতম অস্কারজয়ী অভিনেতা ক্রিস্টোফার প্লামার

এক কথায় বহুমুখী অভিনেতা বলতে যা বোঝায়, তিনি তাই। বিগতও সাত দশক ধরে শুধু সেলুলয়েড পর্দাতেই নয়, মঞ্চের দর্শকদেরও মাতিয়েছেন তিনি। অভিনয় করেছেন ‘দ্য সাউন্ড অফ মিউসিক’, ‘দ্য মায়ন হু উইল বি কিং’, ‘অল দ্য ওয়ার্ল্ড’-এর মতো আইকনিক সিনেমায়। ক্রিস্টোফার প্লামার। ৯১ বছর বয়সে এবার ইতি টানলেন বর্ণময় জীবনের। গতকাল রাতে তাঁর মৃত্যু সংবাদ নিশ্চিত করে তাঁর পরিবার। ক্যান্সিটিকাটে নিজের বাড়িতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন কিংবদন্তি কানাডিয়ান অভিনেতা।

১৯২৯ সাল। কানাডার এক ‘রাজকীয়’ পরিবারে জন্ম ক্রিস্টোফার প্লামারের। ‘রাজকীয়’ বলা এই কারণেই, কেননা কানাডার তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী জন অ্যাবটের নাতি ক্রিস্টোফার। টরোন্টো শহরে বেড়ে ওঠা তাঁর। ছোটো থেকেই ইংরাজি এবং ফরাসি— দুটি ভাষাতেই তিনি কথা বলতে পারতেন সমান দক্ষতায়।

তবে বাড়িতে রাজনৈতিক পরিবেশ থাকার পরেও কোনোদিন তাঁকে টানেনি রাজনীতি। বরং ছোটো থেকেই ছিলেন সংস্কৃতিমনা। বিশেষভাবে ঝোঁক ছিল থিয়েটার, সঙ্গীতে। কাজেই স্কুলের পর আর বেশি দূর এগোল না পড়াশোনা। সোজা তিনি নাম লেখালেন থিয়েটার গ্রুপে— মন্ট্রেল রেপার্টারি থিয়েটার। ১৯৫৬ সালে প্রথমবারের জন্য মঞ্চে অভিনয়। তাও একেবারে স্ট্র্যাটফোর্ড ফেস্টিভালে। ‘হেনরি ফাইভ’ নাটকে হ্যানির চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ক্রিস্টোফার। সেই অভিনয়ের সুযোগ সংক্ষিপ্ত হলেও তা নজর কেড়েছিল দর্শকদের। তারপর ধারাবাহিকভাবেই অভিনয়ের সুযোগ পেয়েছেন তিনি স্ট্র্যাটফোর্ড এবং ব্রডওয়ের বিভিন্ন ছোটো-খাটো অনুষ্ঠানেও। 

আর তার সুবাদেই বছর দুয়েকের মধ্যে এসে হাজির হল সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ। ১৯৫৮ সাল। স্টেজ স্ট্রাক সিনেমায় এক লেখকের চরিত্রে অভিনয় করলেন ক্রিস্টোফার। যেন খুলে গেল অভিনয়ের আরও একটা জগৎ। তার বছর তিনেকের মধ্যেই আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র জগতে এক অন্যতম পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন তিনি। আর ১৯৬৫ সালে তাঁর অভিনীত ‘দ্য সাউন্ড অফ মিউজিক’ এক অন্য মাত্রা এনে দেয় সিনেমাকে। যা নিয়ে নতুন করে বলার নেই কিছুই।

তবে আকর্ষণীয় বিষয়, প্রাথমিকভাবে তাঁর শর্তে পরিচালক রাজি না হওয়ায় অভিনয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেবেন বলেই মনস্থির করে নিয়েছিলেন ক্রিস্টোফার প্লামার। কিন্তু কেন? শুনলে অবাক লাগতে বাধ্য। না, সিনেমার গল্প পড়ে অভিনয়ের থেকেও তিনি বেশি আকর্ষিত হয়েছিলেন গানের জন্য। চেয়েছিলেন ভন ট্র্যাপ পরিবারের মঞ্চ উপস্থাপনার দৃশ্য যেন ডাব করা হয় তাঁর কণ্ঠেই। তবে ডাবিংয়ের জন্য অন্য শিল্পীর ব্যবস্থা করা হলে খানিকটা পিছিয়ে আসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ক্রিস্টোফারকে অভিনেতা হিসাবে পেতে তাঁকেই ডাবিংয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন পরিচালক রবার্ট ওয়াইস। বলাই বাহুল্য, সেক্ষেত্রেও এক অন্য ইতিহাস রচনা করেন ক্রিস্টোফার।

‘দ্য সাউন্ড অফ মিউজিক’-এর পর একের পর এক আইকনিক সিনেমায় অভিনয় করেন ক্রিস্টোফার প্লামার। ‘রয়্যাল হান্ট অফ দ্য সান’, ‘দ্য ব্যাটল অফ ব্রিটেন’, রিটার্ন অফ দ্য পিঙ্ক প্যান্থার’, ‘ওয়াটারলু’, ‘মার্ডার বাই ডিক্রি’— এই তালিকা হয়তো চলতেই থাকবে। তবে ৮০-র দশকের শেষ দিক থেকে কোথাও যেন ক্ষুরধার সেই অভিনেতা সত্তাকে হারাতে বসেছিলেন কানাডিয়ান আইকন। ‘স্টার ট্রেক ৬’, ‘ম্যালকম এক্স’, ‘আনডিসকভার্ড কান্ট্রি’— ইত্যাদি সিনেমাগুলি বাণিজ্যিকভাবে সফল হলেও, তাতে কি সত্যিই অভিনয় করার পরিসর পেয়েছিলেন তিনি? বলা মুশকিল। তবে সিনেমায় অভিনয়ের সৌজন্যে ছাড়েননি মঞ্চও। একদিকে যখন পর্দায় ভালো কোনো চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাচ্ছেন না তিনি, তখন খ্যাতির বিকল্প দরজা খুলে দিয়েছিল সেই থিয়েটারই।

আরও পড়ুন
ভেঙেছেন গো-মাংস, রামমন্দির নিয়ে প্রচলিত ধারণাও; প্রয়াত ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঁ

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে ‘ব্যারিমোর’ নাটকে মুখ্য চরিত্র অভিনেতা জন ব্যারিমোরের চরিত্র দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ২০০২ সালে ‘কিং লেয়ার’ নাটকেও সাড়া ফেলে দেন ক্রিস্টোফার। সেই সুবাদেই হাতে আসে টোনি অ্যাওয়ার্ড।

অনেকটা ফিনিক্স পাখির মতোই সিনেমায় আবার তাঁর উত্থান হয় শূন্য দশকের শেষের দিকে। টলস্টয়ের বায়োপিক ‘দ্য লাস্ট স্টেশন’-এর জন্য তিনি মনোনয়ন পান অস্কারের। যদিও ভোটে সামান্য পার্থক্যের জন্য অভিনেতা ওয়াল্টেজের হাতেই ওঠে সেবারের অস্কার। তবে থামেননি ক্রিস্টোফার। ২০১১ সালে অস্কারে আবার মনোনয়ন বিগিনারস সিনেমার জন্য। এবার মুকুটে জুড়ল সেই পালক। তৈরি হল এক রেকর্ড। প্রবীণতম অভিনেতা হিসাবে অস্কার বিজয়ী হিসাবে লিখলেন নিজের নাম। তবে এখানেই শেষ নয়। ২০১৮ সালে আরও একবার ‘অল দ্য মানি ইন দ্য ওয়ার্ল্ড’ সিনেমার জন্য তিনি পেয়েছিলেন অস্কার। সেবার পুরস্কার হাতে না এলেও আরও একটি রেকর্ড তৈরি করেছিলেন ক্রিস্টোফার। হয়েছিলেন প্রবীণতম অস্কার মনোনীত অভিনেতা।

এছাড়াও ২০০১ সালে কানাডার গভর্নর জেনারেল পুরস্কার, দুটি করে টনি অ্যাওয়ার্ড এবং এমি অ্যাওয়ার্ড ঝুলিতে রয়েছে কিংবদন্তি অভিনেতার। ব্যতিক্রমী ‘গায়ক’ সত্তার জন্য পেয়েছেন গ্র্যামির মনোনয়নও। বলা যেতে পারে মঞ্চের সবটুকুই ইতিবাচক দিককে ছুঁয়ে দেখেছেন তিনি। ২০১৯ সালে কানাডিয়ান টেলিভিশন শো ‘ডিপারচার’-এ শেষবারের জন্য দেখা গিয়েছিল তাঁকে এক মুখ্য চরিত্রে। ভেবেছিলেন মহামারীর পর হয়তো আবারও ফিরে আসবেন সেটে। স্বভাবসিদ্ধ রসিকতায়, কথার ছন্দে মাতিয়ে রাখবেন সকলকে। তবে মহামারী আর কাটল কই? বরং অপেক্ষা করতে করতে নিজেই পাড়ি দিলেন অন্য কোনো জগতের সন্ধানে…

আরও পড়ুন
প্রয়াত শতায়ু ক্যাপ্টেন টম মুর, ইংল্যান্ড জুড়ে শোকের ছায়া

Powered by Froala Editor