কমেছে প্রতিমার বায়না, বাজেটও প্রায় তলানিতে; দেবীপক্ষে অসম লড়াই কুমোরটুলির

শহর জুড়েই ফিরে এসেছে পুজো পুজো গন্ধ। আনাচে কানাচে মাথা দোলাচ্ছে সাদা কাশের দল। আর আল্ট্রামেরিন আকাশ জুড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মেঘ। দুর্গাপুজোর প্রাণকেন্দ্র কুমোরটুলিও নিজের ছন্দেই গুছিয়ে নিচ্ছে শেষ মুহূর্তে কাজ। প্রতিমাকে সাজিয়ে তুলছে মণ্ডপের জন্য। কিন্তু এই বছর সেই চিরাচরিত জৌলুশে যেন খামতি রয়েছে কোথাও। করোনা মহামারীর সঙ্গেই একপ্রকার দড়ি টানাটানি করেই দিন গুজরান করছেন কুমোরটুলির মৃৎশিল্পীরা।

তবে প্রতিবছরের মতোই মৃৎশিল্পীদের মধ্যে একইরকম ব্যস্ততা দেখে অবাক লাগবে বৈকি। তাহলে সত্যিই কি করোনার থাবা বসেনি কুমোরটুলিতে? তেমনটা নয়। অন্য বছর মার্চ মাস থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রতিমা তৈরির কাজ। কিন্তু এ বছর লকডাউনের জন্য সেই কাজই শুরু হয়েছে আগস্টের পরে। তাই শেষ মুহূর্তেই দ্রুততার সঙ্গে হাত চালাচ্ছেন মৃৎশিল্পীরা।

“আমাদের অনেক কারিগরও ছিলেন না। প্রান্তিক জেলা থেকে তাঁরা আসেন আমাদের সঙ্গে কাজ করতে। কলকাতার করোনা পরিস্থিতির কারণে আসতে ভয় পাচ্ছিলেন তাঁরা। কিন্তু এই পরিস্থিতিকে মানিয়ে নিয়েই চলতে হবে, সেটা তাঁরা বুঝেছেন। আগস্টের পর থেকে ধীরে ধীরে কাজে ফিরেছেন তাঁরা”, জানাচ্ছিলেন মৃৎশিল্পী অপূর্ব পাল।

তবে বেশ অনেকটাই কমেছে প্রতিমার সংখ্যা। গত বছরের মতো বায়নাও যে আসেনি, সেটাও ফুটে ওঠে তাঁর কথায়। “আমার তৈরি করা ঠাকুর শুরুই হয় ৮-৯ ফুট থেকে। এবারে সেখানে বেশিরভাগই ৬-৭ ফুটের ঠাকুর, একচালার ঠাকুর। গত বছর যেখানে ৪১টা প্রতিমা তৈরি করেছিলাম। এবার সেই সংখ্যা ২১টায় এসে ঠেকেছে। আসলে যাঁরা কলকাতার আশেপাশের বিভিন্ন জেলা থেকে ঠাকুর নিতে আসেন, তাঁদের বাজেট কমেছে। তাই তাঁরা স্থানীয় মৃৎশিল্পীদের দিয়েই কাজ করাচ্ছেন।” তবে মানসিক চাপ অনেকটাই কম শিল্পীদের মধ্যে, জানালেন অপূর্ববাবু। “অন্য বছরে যেমন বিভিন্ন ধরণের নকশার ওপর কাজ করতে হয়, এবার একদমই সাদামাটা পুজো। ফলে মাথা ঘামানোর কাজটাও আমাদের কমে গেছে।” 

আরেক মৃৎশিল্পী পরিমল পাল মূলত কাজ করেন বিভিন্ন থিম পুজোর। কুমোরটুলি থেকে একটু দূরে আরজি কর হাসপাতালের কাছে তাঁর স্টুডিও। কলকাতার প্রথম সারির একাধিক জনপ্রিয় পুজোর সঙ্গেই নাম জুড়ে থাকে তাঁর। তবে তাঁর কথাতেও ফুটে উঠল একই রকম পরিস্থিতি। কারিগরদের না থাকার সমস্যার কথা জানালেন তিনিও। তবে করোনার প্রভাবে কোপ পড়েছে কাজে। জানালেন, “এ বছর দমদম পার্ক তরুণ সংঘ এবং কাশী বোশ লেন— এই দুটো কাজ শুধু করছি। ব্যাপার হল, প্যান্ডেলই হোক কিংবা প্রতিমা সব দিকেই বাজেটপ্রায় এক-চতুর্থাংশ কিংবা এক-পঞ্চমাংশ হয়ে গেছে। লকডাউনের আগে করা যা বড়ো ঠাকুর ছিল, ওই। তারপর আর নতুন করে কোনো অর্ডার আসেনি। সব ৬-৭ ফুটের ঠাকুর। তবে কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো করেই কাজ হচ্ছে। আমি প্রতিবছর যে ধরণের রেমুনারেশন নিই, তার থেকে অনেকটাই কম নিচ্ছি। যতটুকু নিতে হয়। সনাতন দিন্দা, ভবতোষ সুতার, সুকান্ত পাল— এরা অনেকেই বিনামূল্যেই কাজ করছেন এই পরিস্থিতিতে। আসলে আমরা এত বছর ধরে তো পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে। সেই মানবিক দিক থেকেই পুজোটা যাতে সকলের জন্য হয়, সেই চেষ্টাই করছি প্রত্যেকে।”

আরও পড়ুন
বেলুড় মঠে এবার ভক্তদের প্রবেশ নিষেধ, অনলাইনেই দেখতে হবে পুজো

তবে ঠাকুরের দাম, বাজেট এসব কমলেও সরঞ্জামের ক্ষেত্রে মূল্য আকাশছোঁয়া। তবুও অসম লড়াইটাকেই ধরে রেখেছেন মৃৎশিল্পীরা। লকডাউন ঘোষণার পর থেকে আগস্ট পর্যন্ত সেভাবেই আয়ই হয়নি মৃৎশিল্পীদের। হয়নি বিনিয়োগও। সঞ্চয় ভাঙিয়েই কেটেছে মাঝের মাসগুলো। তবে প্রান্তিক জেলার কারিগররাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সবথেকে বেশি। কুমোরটুলির ব্যবসা খারাপ যাওয়ায় অনেকে কাজও পাননি তাঁরা।

আরও পড়ুন
এগিয়ে আসছে পুজো, করোনাকালে কেমন আছেন কুমোরটুলির ‘বিশ্বকর্মা’র সন্তানরা?

কলকাতার যে পাড়া সারা বছর মেতে থাকে প্রতিমা তৈরি কাজে। সেই পাড়ার মানুষগুলোই মাঝের কয়েকটা মাস যেন হাত-পা বাঁধা হয়েই পড়ে ছিলেন। একটা দুর্বিষহ সময় যে বয়ে গেছে তাঁদের ওপর দিয়ে। তবে পরিমলবাবু জানালেন এই মাঝের সময়গুলো কাটিয়েছেন একটু অন্য রকমভাবেই। “আর্ট কলেজ থেকে আমি পাশ করেছিলাম। তবে তারপর বহু কাজ মাথায় এলেও স্টুডিয়োর কাজের চাপে তাতে আর হাত লাগানো হয়ে ওঠেনি। মার্চের পর অবসর সময়ে তেমনই বেশ কিছু ছবি করার কাজে হাত লাগিয়েছিলাম। তবে কুমোরটুলির অনেক শিল্পীদের কাছেই সেই সময়টা দুর্বিষহ ছিল। জমানো টাকা ভাঙিয়ে খাওয়া। করোনা, তারপর আমফানের ত্রাণ আসত। কিছু শিল্পী সেগুলো ম্যানেজ করা, ডিস্ট্রিবিউট করার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।”

দেবীর একনিষ্ঠ পূজারি বলতে গেলে তাঁরাই। প্রতিমার চক্ষুদান করে পুজোর প্রথম ঘণ্টাটা তাঁরাই বাজান। অথচ এই ভরা উৎসবের মরশুমেও আলো-আঁধার এখন তাঁদের ঘরে। এই দুর্দশা থেকে ‘মা’-ও তাঁদের রক্ষা করতে পারলেন না? এমন প্রশ্নের সামনে মোটামুটি একই বক্তব্য দুই শিল্পীরই। শেষ লগ্নে এসে যেটুকু ব্যবসা হচ্ছে, তা যেন দেবীর দয়াতেই। এমনটাই ফুটে উঠছে তাঁদের মুখে। পরিস্থিতির সামনে এতটুকুও নতজানু না হয়েই ভরসা রাখছেন তাঁরা অদৃশ্যে। শারদীয়ার মধ্যে দিয়ে যে উৎসবের মরশুম শুরু হল তাতে ধীরে ধীরে অল্প হলেও হাল ফিরবে ব্যবসার। অনটন কাটবে প্রান্তিক কারিগরদেরও। সেই আস্থাই রাখছেন তাঁরা।  আশা করছেন, মহামারীর পর মহানগরীর রাস্তায় নামবে মানুষের ঢল। ততদিন এই দুঃসহ পরিস্থিতি কোনোক্রমে পার করতে চাইছেন কুমোরটুলির খ্যাতনামা ‘দেবী’-সন্তানরা...

আরও পড়ুন
দীর্ঘ অপেক্ষার অবসান, পুজোর মধ্যেই চালু হবে দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশন

Powered by Froala Editor

More From Author See More