শান্তি দেবী কি সত্যিই জাতিস্মর? গবেষণায় আগ্রহী খোদ গান্ধীজিও

ঘরের মধ্যে নিস্তব্ধতা। সকলেই অধীর আগ্রহে চেয়ে আছে ছোট্ট কিশোরীর দিকে। পরীক্ষায় সত্যি কি পাশ করতে পারবে সে? এমন সময় দরজা দিয়ে প্রবেশ করলেন এক ব্যক্তি। ‘এঁর কথাই কি তুমি বলছিলে?’, কিশোরীকে প্রশ্ন করলেন তাঁর বাবা। কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকেই তাঁর প্রত্যুত্তর, ‘না, ইনি আমার স্বামীর ছোটো ভাই’। চমকে উঠলেন উপস্থিত সকলেই। এ যে অবাস্তব।

সত্যজিতের সোনার কেল্লার কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? সে গল্পের অন্যতম চরিত্র মুকুল ছিল জাতিস্মর। পূর্বজন্মের স্মৃতিপথ ধরেই সে পৌঁছে গিয়েছিল সোনার কেল্লায়। কিন্তু সত্যিই কি এমনটা সম্ভব? তা নিয়ে বিতর্ক, আলোচনার অবকাশ রয়েছে নিঃসন্দেহে। তবে তিরিশের দশকে দিল্লির কিশোরী শান্তি দেবীর গল্প যেন হুবহু মিলে যায় সোনার কেল্লার সঙ্গে। 

১৯২৬ সালে জন্ম শান্তি দেবীর। বয়স তখন আর কতই বা? বছর দুয়েক। সদ্য কথা বলে শিখেছেন তিনি। সেইসময় থেকেই বার বার তাঁর কথায় উঠে আসত অন্য এক শহরের গল্প। তা কন্যাসন্তানের কল্পনা বলেই শুরুতে ধরে নিয়েছিলেন তাঁর বাবা-মা। কিন্তু যত বাড়তে থাকল বয়স, ধীরে ধীরে পরিণত হতে থাকল তাঁর কল্পকাহিনি। বছর পাঁচেক বয়সে শান্তি দেবী দাবি করেন, গতজন্মে তাঁর নাম ছিল লুগড়ি। বাল্য বয়সেই নাকি তাঁর বিবাহ হয়েছিল মথুরা নগরীতে। ১৯২৫ সালে অক্টোবর মাসে সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যু হয় তাঁর। গতজন্মে কী জামা পরতেন, কী খেতেন, তাঁর স্বামীকেই বা কেমন দেখতে ছিল— এসব এক নিঃশ্বাসেই বলে ফেলতেন শান্তি দেবী। পুরো ছবির মতো তার বিবরণ। তাও মথুরার চলতি ভাষায়। তা না শুনলে, বিশ্বাস করাই দায়। ৭৫ মাইল দূরে অবস্থিত এক শহরের এমন বর্ণনা শুনে বেশ হতবাকই হতেন তাঁর পরিবারের সদস্যেরা। সেই শহরে ঘুরতে যাওয়া তো দূরের কথা, তার গল্পও কোনোদিন কারোর থেকে শোনেননি শান্তি। কিন্তু ছোট্ট শিশুর এই কথা যাচাই করার উপায়ই বা কী?

৯ বছর বয়সে প্রথমবার গতজন্মের স্বামীর নাম প্রকাশ্যে আনেন শান্তি দেবী। পণ্ডিত কেদারনাথ চৌবে। জানান তাঁর বাড়ির পুঙ্খানুপুঙ্খ ঠিকানাও। তারপরই কৌতূহলবশত তাঁর এক আত্মীয় ওই ঠিকানায় চিঠি পাঠান ঘটনার সত্যাসত্য জানতে চেয়ে। আশ্চর্যজনকভাবেই তার প্রত্যুত্তর আসে কয়েকদিনের পরই। হ্যাঁ, শান্তি দেবীর দেওয়া ঠিকানা ছিল কেদারনাথ নামের এক ব্যক্তিরই। কয়েকটা চিঠি আদানপ্রদানেই পরিষ্কার হয়ে যায় গোটা বিষয়টা। কল্পকথা নয়। কেদারনাথ নামের ওই ব্যক্তির পরলোকগত স্ত্রীয়ের নাম সত্যিই লুগড়ি দেবী। আর তিনি প্রাণ হারিয়েছিলেন সন্তানের জন্ম দিতে গিয়েই! 

আরও পড়ুন
নিঃশব্দেই বিদায় নিলেন ‘আফ্রিকার গান্ধী’ কেনেথ কুন্দা

এর পর নিজ-উদ্যোগেই শান্তি দেবীর সঙ্গে দেখা করতে দিল্লি এসেছিলেন কেদারনাথ। চিনতে অসুবিধা হয়নি ছোট্ট কিশোরীর। এমনকি শান্তি দেবীর সঙ্গে একান্তে কথা বলে কেদারবাবু নিজেও মেনে নিয়েছিলেন, তিনিই তাঁর মৃত স্ত্রী। 

আরও পড়ুন
শেষ ১৪ বছরে পাঁচবার হত্যার চেষ্টা, ভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন মহাত্মা গান্ধী

আগুনের মতোই সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ল এই গল্প। গান্ধীজির কাছে গিয়েও পৌঁছল সেই কথা। ১৯৩৫ সালে গান্ধীজি নিজে দেখা করতে গিয়েছিলেন শান্তি দেবীর সঙ্গে। বিষয়টি নিয়ে যাতে বিস্তারিত অনুসন্ধান করা হয়, তার জন্য বিশেষ কমিশনও তৈরি করেছিলেন মহাত্মা। দায়িত্ব দেন মোট ১২ জন সাংবাদিক ও গবেষককে। সেসময় শান্তি দেবীর একাধিক সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়। এমনকি ১৯৩৫ সালের নভেম্বর মাসে শান্তি দেবীর মথুরাসফরের সময়ও সঙ্গী হয়েছিলেন তাঁরা।

আরও পড়ুন
ঠাকুরবাড়ির সরলাকে ‘আধ্যাত্মিক স্ত্রী’ হিসেবে চেয়েছিলেন গান্ধীজি, পিছিয়ে আসেন কস্তুরবার চাপে

এক তদন্তকারীর বিবরণ থেকে জানা যায়, মথুরা স্টেশন থেকে তাঁর দেখানো পথেই গাড়ি চালিয়েছিলেন চালক। এতটুকু ভুল করেননি শান্তি দেবী। সেইসঙ্গে গোটা অঞ্চলের সমস্ত গলি-ঘুঁজি, দোকানের নিখুঁত বিবরণও দিয়েছিলেন তিনি। এমনকি বাড়িতে পৌঁছে মেঝের তলায় ১০ বছর আগের লুকিয়ে রাখা টাকার বাক্স পর্যন্ত বের করে এনেছিলেন শান্তি দেবী। 

তবে শুধু গতজন্মই নয়, পরলোকের গল্পও বার বার উঠে এসেছিল তাঁর কথার মধ্যে দিয়ে। তিনি দাবি করেছিলেন মৃত্যুর পর তিনি দেখা পেয়েছেন কৃষ্ণের। আত্মারা মৃত্যুর পরে ঠিক কীভাবে স্বর্গের নদীতে ভেসে বেড়ায় সেই বিবরণও দিয়েছিলেন তিনি। গোটা জীবন সেই আধ্যাত্মিকতাকে আঁকড়েই বেঁচে ছিলেন শান্তি দেবী। করেননি বিবাহও। ১৯৮৭ সালে ৬১ বছর বয়সে দিল্লিতেই মৃত্যু হয় তাঁর। মৃত্যুর চারদিন আগে শেষবারের মতো সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন সুইডিস লেখক স্টুরে লোনারস্ট্র্যান্ডকে। ১৯৯৪ সালে শান্তি দেবীর জীবন ও তাঁর জাতিস্মর সত্তার তত্ত্ব নিয়ে সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থও প্রকাশ করেন স্টুরে। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয় তার ইংরাজি অনুবাদ। 

তবে শুধু স্টুরেই নন, একাধিক তাত্ত্বিকই পৃথক পৃথকভাবে ব্যাখ্যা দিয়েছেন এই ঘটনার। কিন্তু আজও অমীমাংসিতই রয়ে গেছে জাতিস্মরবাদের রহস্য। কারোর বিশ্বাসে জায়গা করে নিয়েছে সেই তত্ত্ব। আবার রয়েছে বিতর্কের অবকাশও। আসলে কথাতেই তো আছে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর…’

তথ্যসূত্রঃ
The Mind-Boggling Tale Of Shanti Devi, The Indian Child Who Claimed She Lived Twice, Mark Hartzman, Allthatsinteresting.com

Powered by Froala Editor

More From Author See More