শিশুশ্রমিকদের নিয়ে তৈরি স্কুল, লকডাউনের দীর্ঘ ছুটিতে কেমন আছে তারা?

সকাল হতেই অ্যাসিস্ট্যান্ট লেবার কমিশনারের কাছে ছুটেছেন প্রতীম চৌধুরী। বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবস যে আজই! প্রতি বছরের মতো এবারও কি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে উৎসবে মেতে উঠতে পারবেন তিনি? অবশ্য তার জন্য অনেক প্রস্তুতি বাকি। মুশকিল কেবল করোনা ভাইরাসকে নিয়ে। অবশেষে প্রতিরক্ষা কর্মীদের দীর্ঘ জেরার পর স্যানিটাইজেশন এবং থার্মাল চেকআপের বেড়া টপকে দেখা পেলেন অ্যাসিস্ট্যান্ট লেবার কমিশনার অঙ্কন চক্রবর্তীর। এবং শেষ পর্যন্ত হতাশ হতেই হল প্রতীমবাবুকে। এখনও সরকারি বিধিনিষেধের কারণে এমন জমায়েতের অনুমতি দিতে প্রস্তুত নয় প্রশাসন। ফলে এবছর দিনটা প্রতিবারের মতো জমজমাট হবে না।

তা বলে জয়ন্তীপাড়া শিশু শ্রমিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছবিটা যে একেবারে শুনশান, তেমনটি নয়। পঠনপাঠন বন্ধ ঠিকই। তবে স্কুলের আরও বড়ো সামাজিক দায়িত্ব আছে। শৈশব থেকেই বিভিন্ন অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করে পেট ভরায় যে ছেলেমেয়েরা, লকডাউনের সময় তাদের মুখে দুবেলা খাবার জুটছে তো? এই চিন্তা থেকেই গত ২৭ মার্চ থেকে বিদ্যালয় চত্বরেই শুরু হয়েছে একটি কমিউনিটি কিচেন। স্কুলের পড়ুয়ারা তো বটেই, এখান থেকে দুবেলার খবর নিয়ে যাচ্ছেন আরও অনেক হতদরিদ্র মানুষ। প্রতিম বাবুর এই উদ্যোগে সারা দিয়েছেন জলপাইগুড়ি শহরের অন্যান্য মানুষও। কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা নিয়মিত পৌঁছে দিয়ে যাচ্ছে রেশন। আর এভাবেই আড়াই মাস ধরে চলছে এক অন্য কর্মসূচি।

 

কেন্দ্রীয় শ্রম ও রোজগার মন্ত্রকের অধীনস্থ জাতীয় শিশু শ্রমিক প্রকল্পের আওতায় দেশের ২২টি রাজ্যের অনেকগুলি বিদ্যালয়ের একটি জলপাইগুড়ি পৌর এলাকার মধ্যে। জয়ন্তীপাড়া শিশু শ্রমিক প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০০৮ সালের ১ মার্চ কেন্দ্র সরকারের প্রকল্পের অধীনে পথচলা শুরু হলেও স্থানীয় মানুষের কাছে পরিচিত প্রতিমবাবুর স্কুল হিসাবেই। প্রতিশ্রুতি মতো সরকারি সাহায্য ঢোকে না অনেক সময়। প্রতিম বাবুর মাইনেই তো বন্ধ আজ অনেকদিন হয়ে গেল। কিন্তু এর মধ্যেও স্কুলের কাজ তো চালিয়ে যেতে হবে। তাই আজ ১২ বছর ধরে নানা মানুষের কাছে অর্থসাহায্য জোগাড় করে একরকম নিজের জোরেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলেন, "দেশের সব জায়গাতেই তো অবস্থা একইরকম।" তবে তাঁর আক্ষেপ একটাই। আড়াই মাস ধরে বন্ধ পঠনপাঠন। নতুন ভর্তি হওয়া পড়ুয়াদের যে খানিকটা পড়াশুনো তিনি শিখিয়েছিলেন, তারা হয়তো সবটাই ভুলে গিয়েছে। আবার শুরু করতে হবে প্রথম থেকে।

আরও পড়ুন
মৃত মা’কে জাগাতে চাইছে ছোট্ট শিশু, বিহারে পরিযায়ী শ্রমিক মৃত্যুর মর্মান্তিক দৃশ্য

মূলত ৭-৮ বছরের স্থানীয় শিশু শ্রমিকদের নিয়ে ৫০ জনের একেকটি ব্যাচ তৈরি করে পঠনপাঠন চলে জয়ন্তীপাড়া শিশু শ্রমিক প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। একটা ব্যাচ চার বছর ধরে পড়াশুনো করার পর ভর্তি হয় স্থানীয় কোনো হাইস্কুলে। তারপর অনেকেই হয়তো পড়াশুনো ছেড়ে দেয়। তবে বেশিরভাগ পড়ুয়াই পড়াশুনো চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ইতিমধ্যে প্রতীমবাবুর বেশ কিছু ছাত্রছাত্রী ভালো নম্বর পেয়ে মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পাশ করেছে। তাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগও রাখেন তিনি। জয়ন্তীপাড়া এবং হরিজন বস্তির এইসব ছেলেমেয়েদের নিয়েই তো তাঁর ১২ বছর কেটে গেল। এদের কেউ অন্যের বাড়িতে কাজ করে। কাউকে দেখা যায় স্টেশন বাজারে দোকানে কাজ করতে। তবে প্রতীমবাবুর কাছে সবাই ইউনিফর্ম পড়া ছাত্রছাত্রী। কথায় কথায় বলছিলেন, "কাজ শুরু করে প্রথমেই মনে হয়েছিল, এলাকায় প্রায় ৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকার পরেও তো ওরা পড়তে যায় না। তাহলে আমার স্কুলেই বা আসবে কেন? তখন থেকেই ওদের জীবনের সঙ্গে মিশতে শুরু করলাম। অদ্ভুত ওদের জীবন। পড়াশুনোর যে কোনো প্রয়োজন আছে, সেটাই বুঝতে চায় না।" 

আরও পড়ুন
'এই স্যারটা তো আগে গ্রামে আসেক নাই বটে!' - সত্যজিতের সুরে বুঁদ আদিবাসী শিশুরা

 

আরও পড়ুন
মহামারীতে সংকটে পড়তে পারে ৪২-৬৬ মিলিয়ন শিশু, আশঙ্কা রাষ্ট্রপুঞ্জের

প্রতীমবাবুকেও প্রথম প্রথম বেশ অবিশ্বাস করে চলত তারা। কিন্তু এই ১২ বছরে অবস্থাটা বদলেছে। এখন প্রতীমবাবু তাদের একেবারেই আপনার মানুষ। আর শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং শিক্ষাকর্মী মিলিয়ে চারজন তাদের পরিবারেরই অংশ হয়ে উঠেছেন, জানালেন স্কুলের এক শিক্ষিকা জ্যোৎস্না দাস। পড়াশোনাতেও তাদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছেন। বিশেষ করে হাতের কাজ এবং ছবি আঁকা শিখতে প্রত্যেকেই আগ্রহী। বছরে নানা সময় বসে আঁকো প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পাওয়া তো বাড়তি পাওনা। এই মহামারীর মধ্যে সেই পরিবার যেন আরও নিকট হয়ে উঠেছে। এতদিন লড়াই ছিল শুধু সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসার। এখন তো বেঁচে থাকাটাই একটা লড়াই। আর সেই লড়াইতেও ছোট্ট পড়ুয়াদের হাত শক্ত করে ধরে আছেন প্রতিম চৌধুরী, জ্যোৎস্না দাস। হয়তো বিশ্ব শিশুশ্রম বিরোধী দিবসে এই কমিউনিটি কিচেনের থেকে বড় উৎসব আর কিছু হতেই পারে না।

আরও পড়ুন
লকডাউনে বাড়ছে শিশু নির্যাতন, হেল্পলাইনে এগারো দিনে ৯২০০০ অভিযোগ

Powered by Froala Editor