ছোট্ট রুংচুং আর রেনি নদীর গল্প

প্রথম পর্ব

এপ্রিলের ঘুরতে যাওয়া তো কবেই ক্যানসেল হয়েছিল, প্ল্যান হয়েও আগস্টের ভ্যালি অফ ফ্লাওয়ার্স-টা কেঁচে গেল। ৩ বছর কোত্থাও যাইনি ঘুরতে। নিজের সঙ্গে লড়াই করতে কারতে হাঁফিয়ে উঠেছিলাম প্রচণ্ড। ঠিক করলাম, একাই যাব। কোথায় যাব, কিচ্ছু ঠিক না করেই টিকিট কেটে ফেললাম। কাঞ্চনকন্যা রাইট টাইমের আগেই ঢুকিয়ে দিল এনজেপি। অটোতে করে সেবক মোড়ে নেমে বাস ধরলাম কালিম্পং-এর। ঘণ্টা দেড়েক-এ পৌঁছে গেলাম লোহাপুল। সেখান থেকে মিনিট ১৫ হেঁটে পৌঁছালাম দাদার আস্তানায়... আপাতত এইটুকুই ঠিক ছিল।

তারপর রুংচুং। ছোট্ট সাজানো একটা গ্রাম। এর পাশে পাশে যে নদীটা বইছে তার নাম রেনিখোল। পাহাড়-নদী-মেঘ-বৃষ্টি-গ্রামের মাঝে ছোট্ট খেলার মাঠ... প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে যাওয়া।

দুপুরে খাওয়া পর চললাম রেনি-তে স্নান করতে। চোখে দেখেই স্রোতটা বুঝতে পারছিলাম। পা ডোবাতেই ঠান্ডায় পুরো শরীর অবশ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। কোনোমতে একটা পাথরের খাঁজে নিজেকে আটকে নিয়ে তাকিয়ে রইলাম দূর পাহাড়ের দিকে, যেখানে চলছে মেঘের লুকোচুরি।  হঠাৎ বৃষ্টি নামল ঝমঝমিয়ে। এসবই ঘটছে? বিশ্বাস হচ্ছিল না...

বৃষ্টিটা হয়েছে বেশ খানিকক্ষণ। তারপর একটা মিঠে রোদ উঠেছে আকাশে। স্বপ্ন আর বাস্তব গুলিয়ে দেওয়া সীমানাবিন্দুর অনুভুতিগুলো বড়ো মিঠে, ওই ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির পরের রোদটার মতোই... দাদাকে বললুম, তুমি এগিয়ে গিয়ে ভুবনদা-কে চা করতে বলো, আমি আসছি। আসলে, রেনিখোলার বুকের মধ্যে আরো কিছুক্ষণ সেঁধিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল। আমি যে তার প্রেমে পড়েছি। বিকালে ঘুরে দেখলাম রুংচুং। সন্ধে নামা দেখলাম রেনি-র উপর কাঠের ঝুলন্ত ব্রিজটায় বসে।

পরের দিন খুব ভোরে উঠে দেখলাম আকাশের মুখভার। খানিকক্ষণ ঘুরে বেড়ালাম রুংচুং-এ। ওখানকার বাচ্চারা প্রথমবার ক্যামেরা দেখছে। কিছুক্ষণ ওদের সঙ্গে কাটিয়ে নদীর ধার ধরে উপরে উঠতে উঠতে পৌঁছে গেলাম রোলাক-এ। পথে আলাপ সোনমের সঙ্গে। স্বপ্নালু চোখের সোনম শিক্ষক হতে চায়। ওর বাড়িতে গিয়ে চা খেলাম। গ্রাম ঘুরিয়ে দেখালো ওর ভাই বিকাশ। গ্রামে ছোট্ট একটা মনেস্ট্রি, একটা খেলার মাঠ, ২০-২৫টা বাড়ি। অভাব, কিন্তু সহজ-সরল মানুষগুলোর মুখে সারাক্ষণ হাসির ঝিলিক।

ফেরার পর দেখি রেনির ধারে অসংখ্য প্রজাপতি তখন উড়ে বেড়াচ্ছে। নদী পেরিয়ে পাহাড়ি পথে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম আপার রুংচুং-এ। আর তখনই ফের ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। বৃষ্টিটা যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমন হঠাৎ-ই থেমে গেল... সন্ধে নামতে খানিকক্ষণ দেরি। একুটুও সময় নষ্ট না করে বেরিয়ে পড়লাম দু’জনে। কিন্তু খানিকটা নামতেই আর কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না। হেড টর্চ জ্বেলে হাঁটা রাস্তার পথ খুঁজে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছলাম রেনির তীরে।

এসেই ভয়ে আমাদের দুজনেরই অবস্থা খারাপ। গোড়ালি সমান তির তির করে বয়ে চলা জল এখন বইছে হাঁটুর সমানে খরস্রোতে। যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই সন্ধে হয়! এই ভয়ের কথাই পুরো ফেরার রাস্তা জুড়ে আমাদের মাথায় ঘুরছিল। দুজনে ঝুম মেরে বসে পরলাম। কারোরই মাথা কাজ করছে না। কিন্তু ফিরতে তো হবেই... খানিক সাহস করে পা বাড়ালাম। সবচেয়ে ভয় পড়ে গেলে পিঠের ব্যাগে ক্যামেরাটা যাবে! কিন্তু প্রেমিকা হতাশ করেনি...  চুপচুপে ভিজে দু’জনে ঘরে ঢুকলাম...

সন্ধেবেলা নিমন্ত্রণ ছিল পেম্বা দাজুর বাড়িতে। এই গ্রামের সবচেয়ে পুরানো বাড়িটার সবচেয়ে পুরানো মানুষটার সঙ্গে আলাপ হল সেখানেই, পেম্বা দাজুর কাকিমা। গল্প শুরু হল। নানা কথা শুনতে শুনতে মনে হচ্ছিল সময়ের চাকায় চড়ে আমি পৌঁছে যাচ্ছি অন্য কোন সভ্যতায়... মাঝে আড্ডায় এসে পৌঁছেছে চা আর মোমো। পেম্বা দাজু বলছিলেন, কিভাবে রেনিখোলাকে নষ্ট করে, পাহাড় ধ্বংস করে তৈরি হচ্ছে সেবক-রংপো রেল লাইন। কিভাবে পাল্টে যাচ্ছে রুংচুং-এর আবহাওয়া খুব দ্রুত।

প্রসঙ্গত আমার দাদা যে কোম্পানিতে কাজ করে, সেই কোম্পানিই টেন্ডার নিয়েছে সেবক-রংপো রেললাইনের টানেল তৈরির। এখানের মানুষদের সঙ্গে কথা বলে, নিজের চোখে দেখে এলাম প্রকৃতি ধ্বংসের মারণযজ্ঞ। পাহাড়ের গা কংক্রিটে মুড়ে দেওয়া হচ্ছে। তারপর ব্লাস্ট করা হচ্ছে। রুংচুং গ্রামে (ফেস ১) বেশ কিছু বাড়ি ব্লাস্টের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত। রেনিখোলার পাথর খুঁড়ে তুলে ফেলা হচ্ছে বুলডোজার দিয়ে। তারপর সেই পাথর ক্রাসার দিয়ে ছোট করে ঢালাই-এ ব্যবহার করা হচ্ছে। অথচ এর কোনও অনুমতিপত্রই নেই। গ্রামের লোককে বোঝানো হচ্ছে এতে নাব্যতা বাড়বে নদীর। নদী ভালো থাকবে। গোটা এলাকাটাকে ধস প্রবণ তৈরি করা হচ্ছে তিলেতিলে।

ফেস ২ তিস্তার কাছেই। ফলত ওই অঞ্চলে প্রায়ই ধস নামছে সেবক রোডে। কন্ট্রাক্টর কোম্পানি অতি সামান্য মূল্যে পাহাড়ি মানুষদের দিয়ে লেবারের কাজ করাচ্ছে। বাকি সব স্টাফ আনছে বাইরে থেকে। জমি মাফিয়াদের আগে থেকে কিনে রাখা জমি রেল কিনছে। স্থানীয় মানুষ কিছু বলতে ভয় পাচ্ছে। অথচ দৈনন্দিন রাস্তায় ধস নামছে। ফেস ১, ফেস ২-এর কাজ শেষ। আর সেই কাজেও বিস্তর গোলযোগ। সব মিলিয়ে ভয়ংকর অবস্থা! সব দেখে খারাপ হয়ে গেল মনটা!

গল্পে গল্পে সেদিন রাত বাড়ল অনেক। কাল চলে যাব এখান থেকে। গ্রামের মাঝের খেলার মাঠটায় এসে দাঁড়ালাম... চারিদিকে অন্ধকার... মেঘ কেটে আকাশে দেখা দিয়েছে চাঁদ... দূরে জোনাকি বিন্দুর মতো আলো দেখা যাচ্ছে দার্জিলিং-এর... দূরেরেরে আকাশ-পাহাড়ের দিয়ে তাকিয়ে শুয়ে পড়লাম মাঠটার মাঝখানে...

(চলবে)