বকখালির ভোর, দিগন্তের হাতছানি আর পাখি চেনার মুহূর্তেরা

২৪ বছরের জীবনে কোনোদিন সৌভাগ্য হয়নি সমুদ্র দেখার! এই কথা যে মাঝেমধ্যে মাথায় ঘুরত না, তা নয়। তবে সেই নিয়ে আফসোস, দীর্ঘশ্বাস কখনোই টেকেনি বেশিক্ষণ। কলেজ জীবনে বন্ধুদের সঙ্গে অনেকবার প্ল্যান হয়েছে দীঘা কিংবা বকখালির, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি কিছুই। পাহাড়প্রেমী 'আমি'-কে সমুদ্র সেভাবে কোনোদিন টানেওনি। তবে পাখি দেখার নেশা ধরার পর থেকে সমুদ্র টানছিল বেশ, যদিও তা কেবলই নতুন পাখি দেখার জন্য নয়। সমুদ্র নিয়ে যা যা গল্প শুনেছি-পড়েছি, তা চাক্ষুষ করার বাসনাও ছিল!

আরও পড়ুন
যে অভয়ারণ্যে পাখির কলকাকলি, ত্রস্ত হরিণের সঙ্গে রয়েছেন বিভূতিভূষণও

জীবনে নতুন যা হয়, তার বেশিরভাগটাই হঠাৎ করে হয়, ভালো হোক বা খারাপ! তেমনই এক ক্লান্ত দুপুরে হঠাৎ ঠিক হল আর্টিক স্কুয়ার সন্ধানে বকখালি অভিযানের!

আরও পড়ুন
পুরুলিয়ার গা ছমছমে বন, পাহাড়, লালমাটি, হাতির পাল আর গাছের ওপর টং-বাড়ি

কালীপুজোর পরের দিন। আগের রাতে ঘুমাইনি কেউ। খুব ক্লান্ত কিন্তু ভীষণ আনন্দে বাড়ি ফিরেছি। তখন ঘড়িতে সারে বারোটা। স্নান করতে যাব, প্রসীলের ফোন, "বকখালি যাবে? আর্টিক স্কুয়ার(যে পাখির পশ্চিমবঙ্গে প্রথমবার দেখা মিলল। জয়ন্ত মান্নাদার অসাধারণ ফাইন্ডিং) সাইটিং হয়েছে।" আমি এসব ব্যপারে নতুন, কিন্তু প্রসীলের গলার স্বর শুনে বুঝলুম বিষয় জবরদস্ত। তাই কোনোকিছু না ভেবেই ‘হ্যাঁ’! যে আমি খানিকক্ষণ আগে ভাবছিলাম, স্নান করে ঘুমাব, এক ফোনে সব ক্লান্তি দূর হয়ে গেল। উত্তেজনায় ছটফটানিটা ভিতরে ভিতরে ভালোই টের পাচ্ছিলাম বেশ…

আরও পড়ুন
ধ্বংসের মুখে পাহাড়-প্রকৃতি, ট্রেকিং কি নিছক হুজুগে পরিণত হচ্ছে ক্রমশ?

দ্রুত স্নান সেরে ব্যাগ গুছিয়ে নিলাম। ক্যামেরা গোছালাম সবচেয়ে যত্নে। তারপর নাকে-মুখে ভাত গুঁজে বালিঘাট, ট্রেন ধরে শিয়ালদহ। পরের ট্রেন নামখানার উদ্দেশ্যে। লক্ষীকান্তপুর পেরোতেই দু'দিকের দৃশ্য দ্রুত পাল্টে যায়। এতক্ষণের ভিড়ভাট্টার পর ট্রেন মোটামুটি ফাঁকা। দরজায় গিয়ে দাঁড়াই, দু’দিকে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। দেখি দিগন্তের ওপারে সূর্যাস্ত… এইরকম লাল আকাশ শেষ কবে দেখেছি মনে করতে পারছি না! কিছু স্টেশন বহু পুরনো, কাঠের স্ট্রাকচার, অদ্ভুত ধাঁচের। কল্পনা করার চেষ্টা করছি অমাবস্যার নিশুতিরাতে কেমন দেখতে লাগে এদের? কেউ কি লণ্ঠন হাতে অপেক্ষা করে রাতের অনাহূত যাত্রীর জন্য?

আরও পড়ুন
বরফ-ঢাকা স্বর্গের রাস্তা, মৃত মেমের পুলওভার আর ‘মধুসূদন দাদা’-র গপ্প

এইসব ভাবতে ভাবতেই ট্রেন পৌঁছল নামখানা। নেমে মূল রাস্তায় হেঁটে এসে বাস ধরি বকখালির। হোটেলে ঢুকে সন্ধেটা কাটে পাখির গল্পে। মাথার ভিতর আর্টিক স্কুয়ার দেখা পাওয়া-না পাওয়ার চিন্তায় চোরাস্রোত।

আরও পড়ুন
সাতশো রকমের ফুল, ঢেউ-ঢেউ চা-বাগান, গজরাজ আর তিন নদীর দেশের গল্প

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙে প্রসীলের ডাকে। দ্রুত রেডি হয়ে নিচে যাই। আগে থেকেই আকাশকে ফোন করা ছিল টোটোর জন্য। আলো ফোটার আগেই গিয়ে পৌঁছাই অভীষ্ট গন্তব্যে। টোটো থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করি সি বিচ ধরে। প্রথমেই চোখে পড়ে প্রচুর প্রচুর সি গাল। তখন জোয়ার শুরুর সময়, সমুদ্র বেশ খানিক দূরে। জলের রেখা বরাবর উড়ে বেড়াচ্ছে তারা। একটু আলো ফুটতে শার্টার পড়তে থাকল।

আরও পড়ুন
নীল আকাশ, কাঞ্চনজঙ্ঘা আর কোলাহলহীন এক নতুন স্বর্গ—তামাং গাঁও

প্রসীল আর জয়ন্তদা হাতে ধরে চিনিয়ে দিতে লাগল নানা পাখি। একে একে দেখা মিলল লেসার স্যান্ড প্লোভার, প্যাসিফিক গোল্ডেন প্লোভার, ব্ল্যাক বেলিড প্লোভার, রাডি টাংস্টোন, স্যাণ্ডারলিং, লিটিল স্টিন্ট, কমন রেড স্যাঙ্ক, কমন টার্ন, ব্ল্যাক হেডেড গাল, ব্রাউন হেডেড গাল, পালাস গাল ইত্যাদির। তবে সবচেয়ে বেশি আনন্দ পাই দুটি রেয়ার পাখির দেখা পেয়ে - স্তেপি গাল এবং হিউগ্লিন্স গাল। তবে দেখা মিলল না আর্টিক স্কুয়ার!

আরও পড়ুন
মুছে আসা শালবন, মুছে আসা বাংলা, ফুলডুংরি পাহাড়— এই পথে একা একা হাঁটতেন বিভূতিভূষণ

বেলা বাড়লে জোয়ার আসা শুরু হয় আরো কাছে। ক্যামেরা রেখে বাচ্চাদের মতো ঢেউ-এর সঙ্গে ছোঁয়াছুঁয়ি আর বালি নিয়ে খেলা শুরু করি! সেই সঙ্গে কুড়োতে থাকি ঝিনুক! 'বুড়ো বয়েসে ভীমরতি’ও বলতে পারেন। কিন্তু প্রথম সমুদ্র দেখে আমি তখন মুগ্ধ (নিন্দুকেরা এক্ষুণি বলবেন বকখালিতে আবার সমুদ্র কোথায়, শুধুই তো বালি! কিন্তু জীবনে প্রথমবারে সেটাই মোহময়ী মনে হচ্ছিল!)। দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র, তার ঢেউ-এর গর্জন, অপার স্নিগ্ধতা ধুয়ে-মুছে দিল নাগরিক ক্লান্তি…

আরও পড়ুন
মেঘে ঢাকা হ্রদ, বর্ষা-উৎসব আর স্বর্গের নদীপথ

রোদের তেজ বাড়ছে, জল বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই। জয়ন্ত দা, প্রসীল তাড়া দিল হোটেলে ফেরার। আবার বিকেলে আসার প্ল্যান এখানে।

আরও পড়ুন
খাদের পাশে একটা ঘর আর টুকারাম

হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে বিছানায় গড়িয়ে নেওয়া কিছুক্ষণ। তারপর লাঞ্চ করে আকাশকে ফোন দেওয়া। মাথার পিছনে তখনও ঘুরছে আর্টিক স্কুয়ার চিন্তা! বিকালে, সকালে দেখা হওয়া বেশিরভাগ বন্ধুর সঙ্গেই দেখা হল, তার সঙ্গে দেখা হল টেরেক স্যান্ডপাইপার, গ্রিন স্যান্ডপাইপার, হোয়েমব্রেল আর ব্ল্যাক ক্যাপড কিংফিশারের সঙ্গে।

আরও পড়ুন
ছোট্ট রুংচুং আর রেনি নদীর গল্প

একইসঙ্গে দেখলাম প্রচুর প্রচুর রেড ঘোস্ট ক্র্যাব। তাদের জন্য পুরো বালির চর লাল হয়ে আছে। তবে ভাটা এত বেশি যে খুব বেশি পাখির দেখা মিলল না এবেলাও! আমরা চা খেতে ঢুকলাম। সেই সঙ্গে জীবনে প্রথমবার চরাচর লাল হয়ে সমুদ্রে সূর্যাস্ত দেখা, যে দৃশ্য আমার স্মৃতির মণিকোঠায় আজীবন স্থান করে নিল। মনে মনে গুনগুন করছিলুম, "আবার যেদিন তুমি, সমুদ্রস্নানে যাবে, আমাকেও সাথে নিও, নেবে তো আমায়…"

আরও পড়ুন
ঘোড়ার সহিস অর্জুন আর অলীক চৌখাম্বার গল্প

না, আর্টিক স্কুয়ার দেখা পাইনি। তবে জীবনে প্রথমবার কোস্টালে বার্ডিং করতে গিয়ে ১৭টা লাইফার(যেসব বন্ধুদের প্রথমবার চাক্ষুষ করলাম), স্তেপ গাল-এর সঙ্গে প্রথমবারেই মোলাকাত, প্রথমবার সমুদ্র দেখা, সব মিলিয়ে এক অসাধারণ অভিজ্ঞতার সাক্ষী থেকেছি, মানতে আপত্তি নেই…