কারাবন্দি অরবিন্দ ঘোষ ও তাঁর ‘কৃষ্ণপ্রাপ্তি’

১৯০৮ সালের ৬ মে। সহকর্মীদের সঙ্গে আলিপুর বোমা মামলার প্রধান অভিযুক্তরূপে কারাবরণ করলেন অরবিন্দ ঘোষ। ঠিক এক বছর আলিপুর জেলে কারাদণ্ড ভোগের পর, ব্যারিস্টার চিত্তরঞ্জন দাসের নৈপুণ্যে মুক্তি পেলেন তিনি। সেদিন ছিল ১৯০৯ সালের মে মাসের সাত তারিখ। 

অরবিন্দ জানিয়েছেন, সেই এক বছর কারাবাস নয়, আশ্রমবাসের অভিজ্ঞতা হয়েছিল তাঁর, বিপ্লবী অরবিন্দ থেকে ঋষি অরবিন্দ হয়ে ওঠার যাত্রাপথে ওই এক বছর হয়ে উঠেছিল এক অবিস্মরণীয় সন্ধিকাল। কেন? অরবিন্দ জানাচ্ছেন, “অনেকদিন হৃদয়স্থ নারায়ণের সাক্ষাৎ দর্শনের জন্য প্রবল চেষ্টা করিয়াছিলাম; উৎকট আশা পোষণ করিয়াছিলাম জগদ্ধাতা পুরুষোত্তমকে বন্ধুভাবে, প্রভুভাবে লাভ করি। কিন্তু সহস্র সাংসারিক বাসনার টান, নানা কর্ম্মে আসক্তি, অজ্ঞানের প্রগাঢ় অন্ধকারে তাহা পারি নাই। শেষে পরম দয়ালু সর্ব্বমঙ্গলময় শ্রীহরি সেই সকল শত্রুকে এক কোপে নিহত করিয়া তাহার সুবিধা করিলেন, যোগাশ্রম দেখাইলেন, স্বয়ং গুরুরূপে সখারূপে সেই ক্ষুদ্র সাধনকুটীরে অবস্থান করিলেন। সেই আশ্রম ইংরাজের কারাগার।”

অরবিন্দের কারাবাসকালে তাঁর ওপরে নানারকম নির্যাতনের চেষ্টা কিছু কম হয়নি। তার প্রথমটি ছিল মানসিক নির্যাতন, একেবারে সঙ্গী-বিচ্ছিন্ন অবস্থায় একা একটি কারাকক্ষে বাস। প্রথমদিকে এই নির্জনতা তাঁকে বিচলিত করেছিল, কিন্তু তিনদিন একনাগাড়ে ধ্যান ও প্রার্থনার পর তিনি মনের মধ্যে আবার নিশ্চলা শান্তি লাভ করেন। তিনি যাতে কোনোভাবেই মানুষের সঙ্গ না পান, মুক্ত আকাশের নীচে এক মুহূর্তও দাঁড়াতে না পারেন, সে বিষয়ে কারা-কর্তৃপক্ষের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। শারীরিক প্রয়োজনে নিজের কক্ষ থেকে শৌচালয়ে যাওয়াও তাঁর জন্য নিষিদ্ধ ছিল। তাঁর ঘরে দুটি আলকাতরা মাখানো টুকরি রাখা থাকত, তাতেই যাবতীয় প্রয়োজন মেটাতে হত। সকাল-বিকাল দুই বেলা মেথর এসে তা পরিষ্কার করত, কিন্তু অন্য সময়ে বেগ উপস্থিত হলে তার শাস্তি হিসাবে বেশ কয়েক ঘণ্টা দুর্গন্ধভোগ ভিন্ন গত্যন্তর ছিল না। একটিই ছোট্ট কক্ষ একইসঙ্গে শোবার ঘর, খাবার ঘর এবং শৌচালয়। শুধু তাই নয়, তৈজসপত্রের একটিই বাটিতে জল নিয়ে শৌচক্রিয়া করতে হতো, মুখ ধোয়া এবং স্নানের কাজে লাগাতে হত, কিছুক্ষণ পরে সেই বাটিতেই ডাল-তরকারি খাওয়া, জলপান এবং আচমন। অরবিন্দ সকৌতুকে বলছেন, “এমন সর্ব্বকার্য্যক্ষম মূল্যবান বস্তু ইংরাজের জেলেই পাওয়া সম্ভব। বাটি আমার এই সকল সাংসারিক উপকার করিয়া যোগ সাধনের উপায় স্বরূপও হইয়া দাঁড়াইল। ঘৃণা পরিত্যাগের এমন সহায় ও উপদেষ্টা কোথায় পাইব?” 

কারাগারে পানীয় জল বলতে ছিল একটি টিনের বালতির ব্যবস্থা। গ্রীষ্মের দুপুরে সেই জল তেতে আগুন হয়ে থাকত, পান করলে তেষ্টা মেটার বদলে গায়ে ঘাম দিত, অল্পক্ষণেই দ্বিগুণ তেষ্টা ফিরে আসত। আর দু-বেলা আহার্য বলতে মোটা চালের ভাত, তাতেও খোলা, কাঁকর, পোকা, চুল, ময়লা ইত্যাদি মশলার সমারোহ, প্রচুর জল মেশানো স্বাদহীন ডাল, ঘাস-সমৃদ্ধ শাক। মাসের পর মাস একই মেনু। কিছুটা পুষ্টিকর আহার্যের ব্যবস্থা ছিল সকালের ছোটো-হাজারি অর্থাৎ ব্রেকফাস্টে- ফেনশুদ্ধু ভাত অর্থাৎ লপসি। এই লপসির বৈচিত্র্য নিয়েও কৌতুক করেছেন অরবিন্দ— “লফসীর ত্রিমুর্ত্তি বা তিন অবস্থা আছে। প্রথম দিন লফসীর প্রাজ্ঞভাব, অবিমিশ্র মূলপদার্থ, শুদ্ধ শিব শুভ্রমূর্ত্তি। দ্বিতীয় দিন লফসীর হিরণ্যগর্ভ, ডালে সিদ্ধ, খিচুড়ি নামে অভিহিত, পীতবর্ণ, নানা ধর্ম্মসঙ্কুল। তৃতীয় দিনে লফসীর বিরাট মূর্ত্তি, অল্প গুড়ে মিশ্রিত, ধূসর বর্ণ, কিয়ৎ পরিমাণে মনুষ্যের ব্যবহারযোগ্য।” খাদ্য-সংকট বিষয়েও স্থিতধী অরবিন্দ কৌতুকমুখর, এবং সেই কৌতুক তাত্ত্বিক ব্রহ্মচিন্তাময়!

খাবার পর শোয়া। কারাগারে সন্ধে সাতটার সময়ে সন্ধ্যার ঘণ্টা বাজত, একবার কয়েদিরা সকলে রয়েছে কিনা হাজিরা নেওয়ার পর, বিশ্রামের অবকাশ। নিদ্রাসুখই কারাগারের একমাত্র সুখ। অরবিন্দ জানাচ্ছেন, “এই সময় দুর্ব্বলচেতা নিজের দুর্ভাগ্য বা ভবিষ্যৎ জেলদুঃখ ভাবিয়া কাঁদে। ভগবদ্ভক্ত, নীরব রাত্রিতে ঈশ্বর-সান্নিধ্য অনুভব করিয়া প্রার্থনায় বা ধ্যানে আনন্দভোগ করেন।”

কিছুদিন পরে বাড়ি থেকে বই আনাবার সুযোগ পেয়ে গীতা এবং উপনিষদ পাঠে মগ্ন হলেন অরবিন্দ। তাঁর সাধনার গভীরতা উত্তরোত্তর বেড়ে চলল। তিনি উপলব্ধি করলেন, কারাবাসের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে পরমেশ্বর তাঁকে ইউরোপীয় কারাপ্রণালীর দুর্বিষহ-ভাব উপলব্ধি করিয়ে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রেরণা দিচ্ছেন। যেরকম মানসিক নির্যাতনে মানুষ উন্মাদ-দশা প্রাপ্ত হয়, সেই অবস্থাতেও ঈশ্বরের কৃপায় তিনি মনের দুর্বলতা থেকে উত্তীর্ণ হলেন, যোগ-সিদ্ধিকামীর পক্ষে নির্জনতা এবং জনাকীর্ণতার সমমূল্য উপলব্ধি করলেন। অরবিন্দ বুঝতে পারলেন, তাঁর যোগাভ্যাস নিজের চেষ্টায় সম্ভব নয়, শ্রদ্ধা এবং সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণই সিদ্ধিলাভের পন্থা। ভগবান স্বয়ং প্রসন্ন হয়ে তাঁকে যে শক্তি, সিদ্ধি বা আনন্দ দেবেন, সেটুকুই গ্রহণ করে ভগবানের সেবাকার্যে আত্মনিয়োগ তাঁর যোগলিপ্সার একমাত্র উদ্দেশ্য। 

তখন থেকে তাঁর অন্তরের প্রগাঢ় অন্ধকার দূরীভূত হতে আরম্ভ করল, জগতের সমস্ত ঘটনার মধ্যে অনুভূত হতে লাগল পরম মঙ্গলময়ের আশ্চর্য অনন্ত কল্যাণ-স্বরূপ। কারাগার আর তাঁর কাছে কারাগার রইল না, আপাত-অচেতন সমস্ত প্রতিবেশের মধ্যে তিনি উপলব্ধি করলেন সর্বব্যাপী চৈতন্যের উদ্ভাস, সমস্ত ঘটনাপ্রবাহের অন্তরালে এক নির্বিকার নির্লিপ্ত শান্তিময় আনন্দস্বরূপ। এবং, “এক-একবার এমন বোধ হইত যেন ভগবান সেই বৃক্ষতলে আনন্দের বংশী বাজাইতে দাঁড়াইয়াছেন, এবং সেই মাধুর্য্যে আমার হৃদয় টানিয়া বাহির করিতেছেন। সর্ব্বদা বোধ হইতে লাগিল যেন কে আমাকে আলিঙ্গন করিতেছে, কে আমাকে কোলে করিয়া রহিয়াছে। এই ভাব বিকাশে আমার সমস্ত মনপ্রাণ অধিকার করিয়া কি এক নির্ম্মল মহতী শান্তি বিরাজ করিতে লাগিল, তাহা বর্ণনা করা যায় না।”

পুরাণে বলে, কংসের কারাগারে বহুবর্ষ ধরে অজস্র দৈহিক ও মানসিক ক্লেশ সহ্য করার পর, দেবকী ও বসুদেব স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পিতামাতা হওয়ার অতি-দুর্লভ সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন। কারা-ক্লেশ সহ্য করে নিজের যোগসাধনায় নিমজ্জিত ছিলেন অরবিন্দও— বিপ্লবী থেকে ঋষি হয়ে ওঠার পথে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। তাই, ভবিষ্যতে এই এক বছরের জীবন-কালের তাৎপর্য বিষয়ে তাঁর উপলব্ধি, “বৃটিশ গভর্ণমেন্টের কোপদৃষ্টির একমাত্র ফল, আমি ভগবানকে পাইলাম।”

তথ্যসূত্র: 'কারাকাহিনী', অরবিন্দ ঘোষ।

Powered by Froala Editor