দেবীর পায়ের কাছে পড়ে রয়েছেন মহিষাসুর। কাতর কণ্ঠে ভিক্ষা চাইছেন। প্রাণভিক্ষা নয়, মুক্তিভিক্ষা। আর বিজয়ের সেই অন্তিম মুহূর্তে দেবীও হঠাৎ তাঁর হাতের অস্ত্র ফেলে দিলেন। চোখে-মুখে ক্রোধের কোনো লেশও নেই। বরং দেবী দুর্গার চোখও যেন অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণের শ্রী শ্রী চণ্ডী অংশের কিংবদন্তি কাহিনিকে নানাভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে আগেও। কিন্তু এমন দৃশ্যের সামনে একবার থমকে থামতেই হয়। দেবীপক্ষের আগেই এমনই এক আয়োজন নিয়ে হাজির হল ‘ড্রিমসিটি আর্টিস্টস’, যার সঙ্গী আমরা, অর্থাৎ প্রহর.ইন-ও।
“আসলে দেবী দুর্গা এবং মহিষাসুরের যুদ্ধটাই তো মুখ্য নয়। পৌরাণিক কাহিনির মধ্যে নানা রূপকে সমাজের কথা লুকিয়ে থাকে। চরিত্রগুলোর পরিণতির পাশাপাশি তার উত্থানের গল্পটা না বললে সেটা অসম্পূর্ণ থেকে যায়।” বলছিলেন ‘ড্রিমসিটি আর্টিস্টস’ নিবেদিত ‘জয়ং দেহি’-র (Jayang Dehi) পরিচালক আবীর রায় (Abir Roy)। এই নিবেদনে তাই যুদ্ধের চেয়েও বেশি গুরুত্ব পেয়েছে মহিষাসুরের মহিষাসুর হয়ে ওঠার গল্প। একদিকে দানবকুলের উত্থানের উদ্দেশ্য নিয়ে রম্ভাসুর ও করম্ভাসুরের সাধনার শুরু। সেই সাধনাও রক্তক্ষয়ী হয়ে ওঠে দেবরাজ ইন্দ্রের আগ্রাসনে। রম্ভাসুরের চিতার আগুনে ঝাঁপ দেন তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী শ্যামলা। আর সেই চিতার আগুন থেকেই জন্ম নেন মহিষাসুর। দানবকুলের উত্থানের অঙ্গীকার নিয়ে তাঁর জন্ম হলেও এই গল্পের পরতে পরতে ফুটে উঠেছে সেই অঙ্গীকার বিস্মরণের কাহিনিই।
না, প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বেরিয়ে অন্য কোনোভাবে কাহিনিকে দেখার চেষ্টা করেননি পরিচালক। মহিষাসুরও এখানে খলনায়ক ছাড়া আর কিছু নন। কিন্তু যে কোনো কাহিনিই চিরন্তন হয়ে ওঠে তার খলনায়কের চরিত্রগুণে। মহিষাসুরের চরিত্রগুণকেই তাই খুঁজতে চেয়েছেন তিনি। তাঁর এই প্রচেষ্টায় পুরাণ ও শাস্ত্র নিয়ে গবেষণার ভিত্তিতে সমানভাবে সঙ্গত করে গিয়েছেন উৎসব চৌধুরী। আর এভাবেই নতুন যে সৃষ্টি নিয়ে হাজির হলেন তাঁরা, তা যে দর্শকদের মন জয় করে নেবে তাতেও সন্দেহের অবকাশ ছিল না। কোনো বড়ো প্রোডাকশন হাউস নেই। টেলিভিশনে সম্প্রচারের কোনো আয়োজন নেই। শুধুমাত্র ইউটিউবের উপর ভিত্তি করেই গত ৫ দিনে ১২ হাজারের বেশি দর্শকের কাছে পৌঁছে গিয়েছে ‘জয়ং দেহি’।
উপস্থাপনার আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের কথা অবশ্য না বললেই নয়। সেটা হল ভিএফএক্স। পৌরাণিক কাহিনির চিত্রায়ণ যেমন ভিএফএক্স বাদ দিয়েও সম্ভব নয়, তেমনই তার খরচও বিপুল। আবীরের কথায়, “আমি অবশ্য প্রথমে ভেবেছিলাম ভিএফএক্স-এর সাহায্য না নিয়ে কিছুটা নাটকের মতো করে উপস্থাপন করব। তবে পরে মনে হল তাতে একটা বড়ো অংশের দর্শকের কাছে এই কাহিনির রস আস্বাদনে অসুবিধা সৃষ্টি হতে পারে।” যদিও বাণিজ্যিক সিনেমায় ভিএফএক্স-এর যে ব্যাপ্তি সৃষ্টি করা যায় তা যে একটি স্বাধীন চলচ্চিত্র উদ্যোগের পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়, তাও জানতেন তিনি। তাই কাহিনিচিত্র থেকে চিত্রনাট্য তৈরির সময়েই যেন সে-ভাবেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলেন। নানা বাণিজ্যিক সংস্থা বছর বছর এই কাহিনিকে তাঁদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে যেভাবে উপস্থাপন করেন, তার চেয়ে এই চিত্রায়ণ যেন আরও বেশি বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছে এখানেই।
অভিনয় নজর কেড়েছেন শিল্পীরা। দুর্গা চরিত্রে সায়নী চক্রবর্তী এবং মহিষাসুর চরিত্রে সাগরদীপ রায়ের কথা তো বলতেই হয়। এছাড়াও রম্ভাসুর ও শ্যামলার চরিত্রে অমিত ঘোষ ও তৃপ্তি দাস ভট্টাচার্য্যের কথাও আলাদা করে উল্লেখ্য। তেমনই কিছু কিছু ক্ষেত্রে আবহ নির্মাণের প্রশংসাও করতে হয় আলাদা করে। তবে সবকিছুর পরেও একেবারে ত্রুটিশূন্য তো হয় না কোনোকিছুই। ভিএফএক্স-এর ব্যবহারকে মাথায় রেখে চিত্রনাট্য রচনা করতে গিয়েই কোথাও কোথাও মনে হয়েছে চলচ্চিত্রের ধারাবাহিকতায় সাযুজ্য নষ্ট হয়েছে। আবার কখনও কখনও আবহ এতটাই উচ্চকিত হয়ে উঠেছে যে, সেখানে সংলাপ চাপা পড়ে গিয়েছে। তেমনই কাহিনির ব্যাপ্তিকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধরতে গিয়েও যেন অনেকটাই লঘু করে ফেলা হয়েছে। এই উপস্থাপনার নাম ‘জয়ং দেহি’। তবে শুধু জয়ই কি চেয়েছিলেন মহিষাসুর? রূপ চাননি? যশ চাননি? কাহিনিতে সেইসব প্রসঙ্গকে ছুঁয়ে যাওয়ার অবকাশ ছিলই। তবে সামগ্রিকভাবে এই প্রচেষ্টার কাছে এইসব ছোটোখাটো ত্রুটিকে উপেক্ষা করাই যায়। বরং শিল্পীদের স্বাধীন প্রচেষ্টায় এমন একটি উপস্থাপনা যে উদাহরণ তৈরি করল, তা আগামীদিনে আরও নতুন নতুন প্রচেষ্টার অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে, এমনটাই আশা থাকুক।
Powered by Froala Editor