ব্যঙ্গচিত্রী হিসাবে দীর্ঘতম কেরিয়ার, প্রয়াত কিংবদন্তি আল জাফি

১৯৪২ সাল। মাত্র ২১ বছর বয়সে যুক্তরাষ্ট্রের কিংবদন্তি কৌতুক পত্রিকা ‘ম্যাড’-এ অভিষেক হয়েছিল তাঁর। তারপর সকলের অজান্তেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ‘ম্যাড’-এর অন্যতম স্তম্ভ। নয় নয় করে, প্রায় আট দশক সময় কাটিয়ে ফেলেছিলেন ‘ম্যাড’-এর দপ্তরে। এমনকি কমিক শিল্পী হিসাবে দীর্ঘতম কর্মজীবনের জন্য গিনেস বুকের পাতায় নামও উঠেছিল তাঁর।

আল জাফি (Al Jaffee)। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত অসুখে ভুগছিলেন কিংবদন্তি মার্কিন কার্টুনিস্ট। শারীরিক অবস্থার আকস্মিক অবনতির কারণে সম্প্রতি তাঁকে ভর্তি করা হয়েছিল ম্যানহাটনের একটি হাসপাতালে। গত ১০ এপ্রিল হাসপাতালেই প্রয়াত হন রুবেন পুরস্কারজয়ী কিংবদন্তি কার্টুনিস্ট। বয়স হয়েছিল ১০২ বছর।

মার্কিন নাগরিক হলেও, ১৯২১ সালে জর্জিয়ার সাভানার এক ইহুদি পরিবারে জন্ম আল জাফির। ছোট্ট মুদির দোকান চালাতেন বাবা। কিন্তু সেই ব্যবসাও টিকল না বেশিদিন। ইউরোপ-জুড়ে ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি। বাড়ছে ইহুদি-বিদ্বেষ। ফলে, বাধ্য হয়ে ১৯২৭ সালে জর্জিয়া ছেড়ে লিথুয়ানিয়ায় আশ্রয় নেয় জাফি পরিবার। নাৎসি আক্রমণের ভয়ে বছর কয়েক পর ছাড়তে হয় সে-রাজ্যও। শেষমেশ আস্তানা হয়ে ওঠে যুক্তরাষ্ট্র। অর্থাৎ বলতে গেলে গোটা কৈশোর-জুড়ে প্রায় যাযাবর-জীবন কাটিয়েছেন জেফি। ফলে, কৈশোর থেকে চিত্রশিল্পের প্রতি আগ্রহ থাকলেও, আনুষ্ঠানিকভাবে শেখা হয়ে ওঠেনি কিছুই। 

যুক্তরাষ্ট্রে আশ্রয় নেওয়ার পর জুটে যায় সেই সুযোগটা। তিরিশের দশকের শেষ দিক সেটা। নিউইয়র্ক সিটির হাইস্কুল অফ মিউজিক অ্যান্ড আর্টসে ভর্তি হন জেফি ও তাঁর ভাই হ্যারি। অবশ্য তখনও পর্যন্ত কার্টুনিস্ট হয়ে ওঠার কোনো পরিকল্পনাই ছিল না তাঁর। স্বপ্ন ছিল হয়ে উঠবেন একজন নামকরা চিত্রকার কিংবা কথাশিল্পী। কিন্তু ভাগ্য তাঁকে পরিচালিত করল সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। 

আর্ট স্কুলে ভর্তি হওয়ার বছর খানেকের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় বিশ্বযুদ্ধ। ১৯৪১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে এই যুদ্ধের অংশ হয়ে ওঠায়, হঠাৎ করেই বদলে গিয়েছিল পরিস্থিতি। মন্দার বাজার। দু-বেলা ভাত জোটানোই দায় হয়ে ওঠেছিল জেফি পরিবারের। তার মধ্যে চার সন্তানের পড়াশোনার খরচ বহন করাই অসম্ভব হয়ে ওঠে তাঁর বাবার পক্ষে। বাধ্য হয়ে তাই কাজ খুঁজতে শুরু করেন জেফি। পোর্টফোলিও জমা দেন একাধিক মার্কিন পত্রিকার দপ্তরে। এরপর সর্বপ্রথম ডাক আসে ‘ম্যাড’ থেকে। স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয় চিত্রশিল্পী নয়, বরং কার্টুনিস্ট প্রয়োজন তাদের। সুযোগটা হাতছাড়া করেননি জেফি। বরং, চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু করেছিলেন কাজটা। আর তাতে যে তিনি সফল হয়েছিলেন, তা বলার অপেক্ষা থাকে না। 

তবে শুধু কার্টুন আঁকাই নয়, কৌতুক লেখার দক্ষতার জেরেও ‘ম্যাড’-এ নিজের জায়গা পাকা করে নিয়েছিলেন জেফি। সে-সময় মূলত বিশ্বযুদ্ধ নিয়েই বিভিন্ন কার্টুন ও কমিক স্ট্রিপ তৈরি করতেন তিনি। যা রীতিমতো সাড়া ফেলে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের পাঠক মহলে। সেখান থেকেই ধীরে ধীরে কাজের বায়না আসতে থাকে ‘অ্যাটলাস কমিকস’, ‘জোকার কমিকস’, ‘টাইমলি’, ‘মার্ভেল কমিকস’ থেকে। কিংবদন্তি কমিক আর্টিস্ট স্ট্যান লি-র সঙ্গেও বেশ কিছু কাজ করেছেন জেফি। এমনকি বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন গোয়েন্দাদের হয়ে বহু ছবিও এঁকেছেন সমানভাবেই। 

মজার বিষয় হল, খাতায় কলমে জেফির নাম ছিল আব্রাহাম। তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় পেন্টাগনের গোয়েন্দাদের জন্য কাজ করার সময় ‘অ্যালান’ নামটি পান তিনি। পরিচয় গোপনের জন্যই এই নামে পেন্টাগনে প্রবেশ করতে হত তাঁকে। বিশ্বযুদ্ধের পর কর্মক্ষেত্রে এই নামটিকেই আপন করে নেন জেফি। আব্রাহাম থেকে হয়ে ওঠেন ‘অ্যালান জেফি’, সংক্ষেপে ‘আল জেফি’।

‘প্যাটসি ওয়াকার’, ‘দ্য ফার সাইড’-সহ জনপ্রিয় কমিকসের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় সমস্ত সংবাদপত্রেই কম-বেশি রাজনৈতিক কার্টুন এঁকেছেন জেফি। সঙ্গে অক্লান্তভাবেই কাজ করে গেছেন ‘ম্যাড’-এ। বেশ কয়েক বছরের জন্য ছিলেন সে-পত্রিকার আর্ট ডিরেক্টরও। সঙ্গে ‘ম্যাড’-এ স্যাটায়ারিক্যাল প্যারোডি ও ফোল্ড-আউট প্লে-বুকের প্রচলন হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। সবমিলিয়ে বলতে গেলে, মার্কিন কার্টুনকে আধুনিক রূপ দিয়েছিলেন জেফি। কার্টুন জগতে এই অবদানের জন্য ২০০৮ সালে ‘রুবেন’ পুরস্কারে ভূষিত হন জেফি। ২০১৪ সালে পেয়েছিলেন ‘সোসাইটি অফ ইলাস্ট্রেটরস’-এর ‘হল অফ ফেম’। তাছাড়াও আর্কাইভ কলম্বিয়া, ‘উইল আইজনার হল অফ ফেম’-সহ একাধিক পুরস্কার রয়েছে তাঁর ঝুলিতে। ২০১৬ সালে দীর্ঘতম শিল্পীজীবনের জন্য গিনেস বুকেও নাম উঠেছিল তাঁর। যদিও এর আরও চার বছর পর ২০২০ সালে ১০০ বছর বয়সে ‘ম্যাড’ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেন জাফি। তৈরি করেন এক অনন্য নজির। 

বছর কয়েক আগেই প্রয়াত হয়েছিলেন স্ট্যান লি। এবার আরও এক কিংবদন্তি শিল্পীর চলে যাওয়ায় যেন খানিকটা হলেও ম্লান হল মার্কিন কার্টুন তথা কমিকসের গৌরব। ইতি পড়ল ইতিহাসের এক জীবন্ত অধ্যায়ে…

Powered by Froala Editor

More From Author See More