প্রয়াত সত্যজিৎ রায়ের সহকারী পরিচালক রমেশ সেন, দীর্ঘ ৭ দশকের অধ্যায়ে ইতি

১৯৫৫ সাল। বাংলা সিনেমার জগতে সদ্য আত্মপ্রকাশ করেছেন এক পরিচালক। পরে যে তিনিই কিংবদন্তি হয়ে উঠবেন, সেটার আন্দাজ হয়তো পাওয়া গিয়েছিল তখনই। ‘পথের পাঁচালী’ মুক্তি পেল সিনেমা হলে। সেই সময় অ্যাসিস্ট্যান্ট টেকনিশিয়ানের কাজ করতে ঢুকেছিলেন রমেশ সেন ওরফে পুনু সেন। গাঁটছড়া বাঁধার শুরু তখনই। এরপর একে একে সত্যজিতের প্রায় সমস্ত ছবিতেই কাজ করেছেন তিনি। ১৯৬৬ সালে ‘নায়ক’ সিনেমায় তিনি হলেন সহকারী-পরিচালক। তারপর সেই অবস্থানেই কাজ করে গিয়েছেন। ফেলুদা সিরিজ করতে করতে যেন কোথায় গিয়ে পরিবারের অংশ হয়ে পড়েছিলেন। তাই পরবর্তীতে সন্দীপ রায়ের সিনেমাতেও সহকারী-পরিচালকের কাজটা করে গিয়েছেন তিনিই। সেই সম্পর্কে এবার ফাটল ধরল সময়ের নিয়মেই। মঙ্গলবার সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন রমেশ সেন।

বয়স ৯০-এর কোঠা পেরিয়ে গিয়েছিল। তবু বার্ধক্য গ্রাস করেনি তাঁকে। কোনোরকম শারীরিক অসুস্থতাতেও ভুগতে হয়নি। রমেশ সেনের মৃত্যুসংবাদ তাই স্বাভাবিকভাবেই অপ্রত্যাশিত ছিল। এই তো গতবছরই ‘প্রফেসর শঙ্কু ও এল-ডোরাডো’ মুক্তি পেল। ছবির শুটিং-এর জন্য যেতে হবে সুদূর ব্রাজিল। ইউনিটের প্রত্যেকের টিকিট তৈরি হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ রমেশ সেন বললেন, তিনিও ঘুরে আসতে চান। আর কিছু না, ছবি তৈরির গোটা কাজের সঙ্গে যুক্ত থাকতে না পারলে মন ভরে না। অবশ্য তাঁর বয়সের কথা ভেবেই শেষ পর্যন্ত বিরত করেছিলেন সন্দীপ রায়। কিন্তু যে অদম্য সাহসের বশে ৯০ বছরের একজন বৃদ্ধ এতটা পরিশ্রমের ঝুঁকি নিতে রাজি হয়ে যান, তা সত্যিই অবাক করে। এভাবেই মেরুদণ্ড সোজা রেখে হঠাৎ ইন্ডাস্ট্রি থেকে বিদায় নিলেন তিনি।

প্রায় ৭ দশকের অভিজ্ঞতার স্মৃতি ছড়িয়ে রেখে বিদায় নিলেন রমেশ সেন। সেই অভিজ্ঞতার বেশিরভাগটা জুড়েই অবশ্য আছেন সত্যজিৎ রায়। পাশাপাশি অন্যান্য পরিচালকদের সঙ্গেও কাজ করেছেন বহুবার। ‘শ্রীমান পৃথ্বীরাজ’, ‘কুহেলি’, ‘আলোর পিপাসা’; এইসমস্ত সিনেমাতেও সহকারী-পরিচালকের দায়িত্ব সামলেছেন তিনি। অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে তিনি লিখেছিলেন সুচিত্রা সেনের কথাও। পারিবারিক আত্মীয়তার সূত্রে রমা সেন (পরবর্তীকালের সুচিত্রা সেন)-এর শ্বশুরবাড়িতেই একসময় থাকতেন তিনি। তখন সবে টেকনিশিয়ানের কাজে ঢুকেছেন। সিনেমা জগতের নানা গল্প শোনাতেন ‘বউদি’-কে। তারপর রমেশ সেনের অনুরোধেই অভিনয়ে নামার কথা ভাবেন সুচিত্রা সেন।

আবার ‘নায়ক’-এর শুটিং-এর সময় কাজ করলেন উত্তমকুমারের সঙ্গেও। সেই সময়েই উত্তমকুমার একদিন রমেশ সেনকে ডেকে বললেন, সত্যজিৎ রায়ের সহকারী-পরিচালকরা একসঙ্গে যদি একটা সিনেমা পরিচালনা করেন তাহলে তিনি অভিনয় করতে রাজি। হইহই করে শুরু হয়ে গেল পরিকল্পনা। চিত্রনাট্য লিখে দিতে রাজি হয়ে গেলেন স্বয়ং সত্যজিৎ রায়। ছবি তৈরি হবে ব্যোমকেশ কাহিনী ‘চিড়িয়াখানা’ নিয়ে। অবশ্য তার মধ্যেও এসে পড়ল নানা জটিলতা। এর আগে ‘নায়ক’ সিনেমার সেই বিখ্যাত টাকার পাহাড়ের দৃশ্যে নাকি নোট ছাপানোর বিষয়ে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অনুমতি নেওয়া হয়নি। ফলে প্রযোজকের উপর নেমে এল আইনি নিষেধাজ্ঞা। এখন সিনেমা তৈরির টাকা আসবে কোথা থেকে? শেষ পর্যন্ত সত্যজিৎ রায় নিজেই পরিচালনা করছেন জানানোয় সেই সমস্যা মিটল। কিন্তু ছবি তৈরির পরেও তা সিনেমা হলের মালিকরা নিতে চান না। উত্তমকুমার আছেন, কিন্তু তাঁর সঙ্গে কোনো পরিচিত নায়িকা নেই; এমন ছবি তাঁরা নেবেন না।

আরও পড়ুন
মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায় ও একটি 'আকাশ কুসুম' বিতর্ক

সেবছর দুর্গাপুজো এসে পড়েছিল। ‘চিড়িয়াখানা’-র কাজ শেষ। সবাই ভেবেছিলেন সেখান থেকেই অনেকটা উপার্জন হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রায় কিছুই হাতে এল না। এমন সময় সত্যজিৎ রায় পেলেন ম্যাগস্যাসে পুরস্কার। পুজোর আগে সবাইকে ডেকে বললেন, পুরস্কারের অর্থমূল্য তিনি ইউনিটের সবার মধ্যে ভাগ করে দেবেন। লেন্সের আড়ালে মানুষটার এমন কোমল অনুভূতি দেখে সবাই অবাক হয়েছিলেন। অবশ্য তার প্রমাণ আরও নানা সময় পাওয়া গিয়েছে। কোনো সিনেমার শুটিং-এর জন্য ট্রেনযাত্রার সময় পরিচালক নিজে খবর নিতেন প্রত্যেকের শোয়ার ব্যবস্থা ঠিকঠাক হয়েছে কিনা। তারপর নিজে ঘুমোতেন। কাজের সূত্রে এভাবেই তাঁকে চিনেছিলেন রমেশ সেন। আর সেই ইউনিটের শেষ সদস্য রমেশ সেনও চলে গেলেন অজ্ঞায় জগতে। শুধু থেকে গেল টুকরো কিছু স্মৃতি।

আরও পড়ুন
সত্যজিৎ-এর ‘পিকু’ হয়তো সম্ভব হত না বার্গম্যানের একটি ছবি না দেখলে

তথ্যসূত্রঃ ‘Manikda was uncompromising’, Interview by Indrani Dutta, The Hindu
‘তিনি আমার কাছে নায়িকা নন, বউদি’, রমেশ সেন, এইসময়
চিড়িয়াখানার তুমি কী জানো, রমেশ সেন, আনন্দবাজার পত্রিকা
ছবিঋণঃ সৌম্যকান্তি দত্ত
বিশেষ কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ সৌম্যকান্তি দত্ত, প্রিয়ক মিত্র

আরও পড়ুন
সত্যজিৎ ছাড়া কেউ বোঝেননি তাঁকে, অভিমান বুকে নিয়েই বিদায় ‘মন্দার বোস’-এর

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
'পথের পাঁচালী'র সেটে আলাপ, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে বললেন সৌমেন্দু রায়

More From Author See More