মাটির খুঁড়ে উদ্ধার পসেইডনের মূর্তি, ইন্দো-রোমান বাণিজ্য ইতিহাসের সাক্ষী মহারাষ্ট্র

মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে বেরিয়ে আসছে একটার পর একটা প্রাচীন বস্তু। প্রত্নতাত্ত্বিকরাও ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন, আরও গভীরে ঢুকতে চাইছেন। হঠাৎই তাঁদের চমকে দিয়ে মাটির তলা থেকে বেরিয়ে এল একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি, সঙ্গে বেশ কিছু মুদ্রা। একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছেন; একটি পা পাথরের ওপর, বাঁ হাতটি ওপরে তোলা— যেন কিছু ধরে আছেন। কার মূর্তি এটা? প্রত্নতাত্ত্বিকদের অভিজ্ঞ চোখ ধরে ফেলল এর পরিচয়। নিশ্চিতভাবেই এই মূর্তি গ্রিক-রোমান দেবতা পসেইডনের। আর মুদ্রাগুলোও রোমান চিহ্ন বহন করছে। কোথায় পাওয়া গেল এসব? ইতালি বা ইউরোপের কোনো দেশে নয়; খোদ ভারতেই পাওয়া গেল রোমান যোগাযোগ…

যে ঘটনাটির কথা বলা হল, সেটি ১৯৪৫ সালের। মহারাষ্ট্রের কোলাপুর জেলার ছোট্ট একটি জায়গা ব্রহ্মপুরী। একেবারে পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পঞ্চগঙ্গা নদী। আর সেখানেই মাটির ভেতর থেকে ইতিহাস খুঁজে পেলেন ঐতিহাসিক ডঃ এইচ ডি সঙ্কলিয়া। ভারতের মতো প্রাচীন একটি দেশে এরকম কত ইতিহাসই লুকিয়ে আছে। এখনও অনেক ইতিহাস আমাদের সামনে উঠে আসেনি। তাহলে ব্রহ্মপুরীর প্রত্নতত্ত্ব নিয়ে এত কেন আলোচনা? এর গুরুত্ব কোথায়? 

একটাই কারণ— ভারত এবং রোমান যোগাযোগ। এত প্রকটভাবে রোমান প্রত্নসামগ্রীর সন্ধান খুব কম সময়ই পাওয়া গেছে। মাটির তলা থেকে উঠে এসেছে বেশ কিছু মুদ্রা, এবং অবশ্যই ব্রোঞ্জের তৈরি লম্বা একটি পসেইডনের মূর্তি। যা সরাসরি ভারত আর রোমের বাণিজ্য-সম্পর্কের দিকে আলো ফেলে। কোলাপুরের টাউন হল মিউজিয়ামে গেলেই দেখা যাবে সেইসব নিদর্শন। এবং এদের হাত ধরেই ঐতিহাসিকরা পাড়ি দিয়েছেন সেই সময়ের দিকে, যখন রোমান জাহাজ এসে ভিড়ত মহারাষ্ট্রের উপকূলে… 

শুরু করা যাক খ্রিস্টপূর্বাব্দ প্রথম শতক থেকে। ভারতের বুকে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রাজবংশ শাসন করে গেছে। ঠিক সেরকমভাবেই দক্ষিণ ভারতে শুরু হয়েছিল সাতবাহন সাম্রাজ্য। মূলত দক্ষিণ ভারতেই আধিপাত্য ছিল এদের। পাইথান, অমরাবতী থেকে ধীরে ধীরে একটা সময় সমস্ত মহারাষ্ট্রেই ছড়িয়ে পড়ে সাতবাহনরা। মহারাষ্ট্র, বিশেষ করে কোলাপুরের মতো জায়গা দখলে আসার ফলে আরব সাগরের দিক খুলে যায় তাঁদের কাছে। আর ইতিহাস বলে, এই সাতবাহন রাজাদের আমলে সমুদ্রপথে বাণিজ্যের বিস্তার হয়েছিল। 

এবার আসা যাক ২০ খ্রিস্টাব্দের কথায়। হিপোলাস নামের এক গ্রিক নাবিক প্রায় হঠাৎ করেই মিশর থেকে ভারতে আসার সামুদ্রিক রাস্তাটি খুঁজে পায়। বলা যেতে পারে, এটাই ইতিহাসের মোড় ঘোরানো ঘটনা। কারণ, এরপর গ্রিস, রোমের মতো পৃথিবীর প্রাচীন ও ঐতিহ্যশালী সভ্যতার দরজাটি খুলে যায় ভারতের কাছে। একইভাবে, ভারতের মতো ‘অজানা’ দেশটিতেও পৌঁছতে পারে বিদেশিরা। হিপোলাসের এই আবিষ্কারের ফলে সাতবাহন ও রোমানদের মধ্যে একটা বাণিজ্যিক সাঁকো তৈরি হয়। রোমানদের বড়ো বড়ো জাহাজ হাজির হয় ভারতের পশ্চিম উপকূলে। মহারাষ্ট্রের বুকে রোমানদের পদচিহ্ন পড়ে। কোলাপুর, ব্রহ্মপুরী হয়ে ওঠে অন্যতম প্রধান বাণিজ্যক্ষেত্র…

মনে করা হয়, তখনই এই পসেইডনের মূর্তি এবং মুদ্রাগুলি কোলাপুরে এসে পৌঁছয়। ঐতিহাসিকরা দুটো সম্ভাবনার কথা বলেছেন; এক- পসেইডন যেহেতু সমুদ্রের দেবতা, তাই শান্তিপূর্ণ সমুদ্রযাত্রার জন্য রোমানরা এর একটি মূর্তি নিয়ে আসত। সেভাবে এই মূর্তিটিও এখানে এসে পৌঁছেছে। আর দ্বিতীয় সম্ভাবনা, মহারাষ্ট্র থেকে কেউ একজন রোমে গিয়েছিল। সেখান থেকে উপহার হিসেবে এই পসেইডনের মূর্তিটি নিয়ে আসেন। শুধু তাই নয়, প্রাচীন পম্পেই শহরেও ভারতের দেব-দেবীর মূর্তি পাওয়া গেছে। যাই হোক, এই পুরো ছবিটাই যে ভারত-রোম প্রাচীন বাণিজ্যকে নির্দেশ করছে তা বোঝাই যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
মানুষের সমাধি ঘিরে বন্যপ্রাণীর মূর্তি, ক্ষমতা ‘নিয়ন্ত্রণে’র অদ্ভুত বিশ্বাস কলম্বিয়ার উপজাতিদের

তথ্যসূত্র – ‘Kolhapur’s Roman Connection’, Live History India 

Powered by Froala Editor

More From Author See More