নব্বইয়ের দশক, গ্রিটিংস কার্ড আর জানলা দিয়ে ছুড়ে দেওয়া ‘ভালোবাসা’র চিঠি

দুষ্যন্ত জানতেন, সবই। কিন্তু, শকুন্তলা কী করে জানবেন যে, কালিদাস ইতোমধ্যে গোপনে গোপনে তাঁর কানে সব-কথাই তুলে দিয়েছেন! এদিকে, হৃদয়ের ভার অসহ হল তাই, সহায় প্রিয়ংবদা; ভেবেচিন্তে তিনি ঠিক করলেন, প্রেম-পত্র দিয়েই যা-বলার তা বলে ফেলা যাক। প্রত্যাখ্যানের ভয় থাকে বটে! কিন্তু গুণের অবমাননা করাও তো তেমন কাজের কথা নয়! শরীর জুড়নো যে শরতের জ্যোৎস্না, তাকে আঁচলে আর কে ঢাকে! অতএব পদ্মপাতায় আঁচড় কেটে লেখা হল,- ‘হে নিষ্ঠুর, তোমার মনের কথা আমি জানি না, তবে দিনরাত কামদেব তোমাতে একান্ত অনুগামী আমার অঙ্গগুলিকে অত্যন্ত তাপিত করছেন।’ যেই না এ-কথা বলা অমনি রাজাকে সামনে এনে কালিদাস বলিয়ে নেবেন, যে, মদনবাণে হত রাজা পুনরায় হত হলেন; তাতে নাটকের সবদিক রক্ষিত হল, কিন্তু, বাস্তবে যে প্রেম-পত্র সকলই অঙ্কের স্যারের হাতে নয় পায়ে গিয়ে পড়ে, এ-সম্ভাবনা আঁচ করা বুঝি কালিদাসের কল্পনারও অতীত। অথচ, কে না জানে, যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই…

বার দুই এমন সন্ধে হলে, গাঁ-গঞ্জের ইশকুলে রীতিমতো সন্ত্রাস। একবার টেবিলে জমা দেওয়া অঙ্কের খাতা উলটে গিয়ে খসে পড়া পত্রখানি উঠল স্যারের হাতে, আর-একবার জানলা দিয়ে কোনো এক শৈবালবিদ্ধা কমলিনীর উদ্দেশে ছুড়ে দেওয়া চিঠি সময়জ্ঞানের মাত্র এদিক-ওদিক হেরফেরে গিয়ে পড়ল স্যারের পায়ের কাছে। অতঃপর? গার্জেন কল? নাকি টিসি! সমস্ত সম্ভাবনা নিয়ে দলে দলে আলাদা বৈঠক! এমনকি কিছু কূট প্রসঙ্গও ছিল, সে-সব আলোচনায়; যথা, যে-মেয়েটিকে তাক করে ছুড়ে দেওয়া হয়েছিল চিঠিখানা, আদৌ কি তার কোনো দোষ থাকতে পারে! যে-কারণে তারও গার্জেন কল হতে পারে ইত্যাদি।

কালিদাস মহানুভব। তাই প্রণয়প্রকাশে চিঠি লেখার কাজটি শকুন্তলাকে দিয়ে করিয়েছিলেন। কিন্তু উল্লিখিত দুই ক্ষেত্রেই সে-বিষয়ে অগ্রণী ছাত্রটিই। যারা কেবল পুং কিংবা কেবল স্ত্রী স্কুলে পড়েছে, তারা গ্রীষ্ম কিংবা শীত; বসন্ত তাদের কাছে স্বয়মাগতা নয়। সকলে নয়, ভাগ্যবান কেউ কেউ-ই কো-এড; হাত-ধরাধরি জল-ছেটাছেটি বয়স পেরিয়ে কবে যে কবোষ্ণ দিনকাল আষ্টেপৃষ্ঠে তাদের বেঁধে ফেলে, তারা নিজেরাও জানে না; হঠাৎ একদিন খেয়াল হয়, চুলের ঢেউ বাঁধ ভাঙছে। রেক্সোনা ডিওস্টিক, ব্যাগের ছোটো পকেটে; তবুও তরুণ ঘামের গন্ধ। যৌবনেরও; ক্লাসরুমে ‘তপোবন-বিরোধী’ হাওয়া।

এমতাবস্থায় প্রণপ্রকাশের স্বাভাবিক যে-কটি উপায় আছে তার মধ্যে স্নিগ্ধবীক্ষণ এতক্ষণে সম্পন্ন। অর্থাৎ সপ্রেম তাকানোয় যা বোঝানোর তা কিছুটা বোঝানো হয়েছে। তা ছাড়া গেল সরস্বতী পুজোয় ক্রমাগত পাশে পাশে থাকার চেষ্টাও যথেষ্ট ইঙ্গিতময়তা বহন করেছে। দূতীসম্প্রেষণ, অর্থাৎ বন্ধু পাঠানো, সেও কি আর হয়নি! তবে কপালের দোষ! যে-বন্ধুটি প্রস্তাব নিয়ে গেছে, সেও তো সেই হাফপ্যান্টবেলার বন্ধু, এইসব কথা বলার পর বেদম ঝাড় খেয়েছে। আর ফিরে এসে কামদেবের বাণে বিদ্ধ পুরুষসিংহটিকে বাছা বাছা কয়েকটি চার অক্ষর শুনিয়ে বলে দিয়েছে, এসবের মধ্যে সে আর নেই। ফলে, নায়ক আর এগিয়ে গিয়ে নম্রভাষণের ঝুঁকিই নেয়নি। শকুন্তলার ক্ষেত্রে নয় শরতের জ্যোৎস্না আঁচলে না-লুকিয়ে রাখার একটা তাৎপর্য থাকে, কিন্তু এখানে নায়ক তো জানে যে, তুতলে ফেললেই কেউ শাহরুখ খান হয়ে যায় না! অগত্যা, অন্ধের যষ্ঠী; বাকি এই লেখ্যসম্প্রেষণ অর্থাৎ কিনা চিঠি পাঠানো; তাতেই দুই সিনিয়র ডাহা কেস খাওয়ায় সদ্যপ্রেমিকগণ যে সন্ত্রস্ত হয়ে পড়বে, এতে আর আশ্চর্যের কী আছে!

প্রায় অচলাবস্থা; নাটকের অঙ্ক আর এগোয় না। এই পরিস্থিতিতে এল-দেখল-জয় করল, এক এবং অদ্বিতীয়, গ্রিটিংস কার্ড। ছাপোষা, নিরীহ; তবু ব্রহ্মাস্ত্র। সত্যি বলতে কি, এর অমিত সম্ভাবনার কথা গোড়াতে আঁচ করা যায়নি। ফলে যাবতীয় উপযোগিতা জন্মদিন কিংবা বর্ষবরণের বিলাসিতাতেই আটকে ছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয়তাই আবিষ্কারের জননী এবং দূরদ্রষ্টাদেরও মাত্র দুটোই চোখ থাকে- এই দুই সমীকরণ মিলিয়ে নিতেই, একদিন এক্কেবারে প্রব্লেম সলভ্‌ড। সকলই বলা যায়, কিছুই না-বলে। এর পিছনে গোলোকায়নের রহস্য আছে নাকি পাড়ার দোকানির প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, সে বিচারের ভার মহাকালের। কিন্তু চিঠির ধকল ও ধাক্কা সামলে গ্রিটিংসের ব্যবহারে এক অগ্রণী প্রেমিক যখন অভাবনীয় সাফল্য পেল, তখনই গ্রিটিংস হয়ে উঠল সার্বজনীন প্রেমের ইশতেহার। এক তো অমন টুকটুকে খাম। তার উপর সোনালি বা রুপোলি কালিতে লেখা- ‘টু অমুখ’। এমন জিনিস হাতে দিলে কেই-ই বা আর ফেরাবে! তা ছাড়া ছুতোনাতায় যে একেবারে গ্রিটিংস কার্ড কেউ নেয়নি, এমন কথা তো কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না! ফলে নিতে না-চাওয়ার সম্ভাবনা কম। চিঠির সেই শতভাঁজ কাগজ হাতে গুঁজে দেওয়ার থেকে অনেক স্মার্ট উপায়। বাড়তি পাওনা দুটি। কোনো কোনোটার উপর চমৎকার খাঁজকাটা গোলাপের তোড়া। আলাদা করে তাই ফুল আর দিতে হয় না। ট্যাঁকের জোরও তত নেই, যে, ফুল কেনা যায়; তাছাড়া গাঁ-গঞ্জ-মফস্‌সলের বাজারে এমনকি গোলাপের সহজলভ্যতা না-থাকলেও গোলাপের বিকল্প হয়ে কার্ড ঢুকে পড়েছিল অনায়াসেই। আর কার্ডের ভিতরে একেবারে ঝরঝরে কাব্যিক ইংরেজিতে ছ-লাইনে সব কথা লিখে দেওয়া আছে। তুমি আমার চাঁদ-তারা থেকে আমি তোমার মহাবিশ্ব ও মহাবিস্ময়- সবই। ফলে উপরে ‘টু’ আর নিচে ‘ফ্রম’টুকু কায়দা করে লিখলেই হল। আর কিছু না-লিখলেও চলে। বানান ভুলের চান্সও নেই। একেবারে রেডিমেড ইনস্ট্যান্ট সলিউশন চলে এসে প্রেমপ্রকাশের ধারাটিকেই বদলে দিল কয়েকটা প্রজন্ম জুড়ে।

এখানেই শেষ নয়। যে-কথাটি বলে ওঠা এ-পৃথিবীতে সর্বাধিক কঠিন, সেই ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ও বলে দেওয়ার দায়িত্ব নিল কার্ড। অর্থাৎ প্রণয়প্রকাশের দুটি পদ্ধতি – প্রেম-পত্র ও নম্রভাষণ - এক দেহে হল লীন। তবে দেখলে হবে না, খরচা আছে। একটু বেশি দাম পড়ে বইকি। কিন্তু সে কার্ড যে দেখেছে সে না নিয়ে থাকতে পারেনি। কার্ড খুললেই, ধাপে ধাপে খুলে গিয়ে তৈরি হত গোলাপের একটা বোকে। আর তারপর টুঁইটুঁই স্বরে এক রমণীকণ্ঠ গেয়ে উঠত, আই লাভ ইউ… ইত্যাদি ইত্যাদি। সেই মিউজিক কার্ড যে কত হৃদয়বন্ধনে ঘটকালি করেছে তার ইয়ত্তা নেই। ‘ভালোবাসা মানে আর্চিজ গ্যালারি’- এ কি আর সাধে গেয়ে উঠেছিল প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা!

তবুও সময়, ঘাতক। পলাতক; কার্ড যে আর নেই তা নয়। এখনও দোকানে, বিশেষত শপিংমলে তার দেখা তো পাই। অনলাইনে গিফট অর্ডার করলে তাতেও কার্ড দেয়। এমনকি পার্সোনাইলাইজড্‌ করার ব্যবস্থাপনাও আছে আজকাল। সম্ভবত নেই শুধু আর সেই শিহরন। না, বয়স কেবলমাত্র এর জন্য দায়ী নয়। দায়ী, তথাকথিত কানেক্টিভিটি। এই মেসেঞ্জার, হোয়াটস-অ্যাপ, টিন্ডারের আমলে একখানা কার্ডেতে যত্নে লেখা নাম কি আর সেই বুক দুরুদুরু বয়ে আনে! না আনতে পারে! মেসেজ তো এখন করে ফেলে ডিলিটও করা যায়। অথচ কার্ডেলেখা যে-সব নাম, সে-নাম থেকে গেছে! তারা কি এখন দম্পতি ঘোরতর! নাকি সে আজ অন্যের ঘরণী কিংবা পরের পুরুষ! হয়তো বা, কিংবা নয়। কী যায় আসে! পুরনো ডায়রির ভাঁজে শুধু বাঁধা পড়ে আছে একঝাঁক জোনাকি। তাদের আলো-জ্বলা আছে, উড়ে যাওয়া নেই।

More From Author See More