গালিগালাজের পর, রবি ঘোষের গালে থুতুমেশানো চুমু খেলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়

কবি তারাপদ রায় ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের বন্ধু। নিছক মুখ-চেনাচেনির বন্ধু নয়, যাকে বলে রীতিমতো ঘনিষ্ঠ বন্ধু। একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়া থেকে শুরু করে কৃত্তিবাসী আড্ডা – অভাব ছিল না কিছুরই। সেই তারাপদ রায়েরই একটি কবিতা আছে শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। শক্তি তখন প্রবল জনপ্রিয় এক কবি। দেখা যাক কবিতাটি –

গতবছর ব্যাঙ্গালোরে না হায়দ্রাবাদে
কে যেন একজন বোকার মত
আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো,
‘শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে চেনেন?’
একটু বিরক্ত হয়ে, তারপর কিন্তু নিজেই মনে মনে
থমকিয়ে গিয়েছিলাম,
শক্তিকে চিনি? শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে?
ভদ্রলোককে বিনীতভাবে বলেছিলাম,
‘উনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন।’

তারাপদ রায়ও থমকেছিলেন। সত্যিই কি শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে চেনা যায়? বাইরের ও ভেতরের মানুষটাকে আপাতদৃষ্টিতে মেলানো খুবই শক্ত। উদ্দাম, মাতাল, বেপরোয়া শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর তাঁর নিমজ্জিত কবিতাগুলিকে চট করে মেলানো যায় না কিছুতেই। আবার, গভীরে ডুব দিলে হয়তো সেই যাপনই তাঁকে নিয়ে গেছে অবিস্মরণীয় সব কবিতার কাছে।

আরও পড়ুন
ভাই ঢুকে যাচ্ছে চুল্লিতে, পা ধরে তাকে আকাশে ছুড়ে দিলেন জয় গোস্বামী

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, তাঁর বন্ধুদের মধ্যে শক্তিই প্রথম বা একমাত্র, যিনি শুধু কবিতা লিখতে চেয়েছিলেন। আর কিচ্ছু না। সুনীলের কথায়, ‘এত বড় ঝুঁকি আর কেউ নেয়নি, এ এক সাঙ্ঘাতিক জুয়া খেলা। নিজের জীবনটাকেই শক্তি বাজি ফেলল। যদি দৈবাৎ কোনো দুর্ঘটনায় ওর কলম শুকিয়ে যেত, তাহলে ওর স্থান হত কোথায়?’

অথচ শক্তিকে নিয়ে উচ্চাশা ছিল প্রথম থেকেই। কমলকুমার মজুমদার শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সম্পর্কে রবি ঘোষকে বলেছিলেন – ‘ছেলেটার লেখার মধ্যে ইমেজারি আছে।’ পরবর্তীকালে রবি ঘোষ যখন অভিনেতা হিসেবে খ্যাতির তুঙ্গে, তখনও শক্তির আচরণ পাল্টায়নি। দেখা হলেই প্রচণ্ড গালিগালাজ করতেন, আর বিদায় নেওয়ার আগে থুতু মেশানো একটা চুমু খেয়ে যেতেন রবি ঘোষের গালে। রবি ঘোষ কিন্তু এই ‘বন্ধুত্ব’ নিয়ে গর্বিতই ছিলেন। নিজেই বলেছেন, একসঙ্গে বহুবার মদ খেলেও, শক্তি সঙ্গে তাল মেলানোর ক্ষমতা ছিল না তাঁর।

শক্তিকে নিয়ে একই মুগ্ধতা নাট্যব্যক্তিত্ব বিভাস চক্রবর্তীরও। তাঁর কথায়, ‘ছবি(ফিল্ম) বলতে যা বুঝতাম, ভেঙে দিয়েছেন সত্যজিৎ রায়, থিয়েটার বলতে যা জানতা, ভেঙে দিয়েছেন শম্ভু মিত্র, আর কবি বলতে যে ধারণা ছিল ভেঙে দিলেন শক্তিদা।’ নবনীতা দেবসেন মনে করতেন, মৃত্যুচেতনায় শক্তি জীবনানন্দের খুব কাছাকাছি।

আরও পড়ুন
বইটি ‘বান্ধবীকেন্দ্রিক’, বারবার নাম বদলেছেন বিনয় মজুমদার

শক্তির প্রথম বইয়ের নাম ‘হে প্রেম হে নৈশঃব্দ্য’। প্রকাশক দেবকুমার বসু। শক্তির খামখেয়ালিপনার শিকার তিনিও। খামখেয়ালিপনা, না আরও নিখুঁত হওয়ার ইচ্ছে? ১৯৫৮ সালের আগস্টে প্রথম বইয়ের পান্ডুলিপি জমা দেন শক্তি। তারপরই উধাও তিনি। মাস সাতেক পরে প্রেসে গিয়ে নতুন প্রুফ দিয়ে এলেন শক্তি। বদলে গেছে পাণ্ডুলিপির অর্ধেক কবিতা। তারপর আবার নতুন প্রুফ, আবার কবিতা বাতিল। এভাবে চলতে চলতে, ১৯৬১ সালে গিয়ে বেরোল শক্তির প্রথম বই। নামও বদলানো হয়েছে একাধিকবার। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, বইয়ের নাম হবে ‘নিকষিত হেম’। তারপর ‘কেলাসিত স্ফটিক’। অবশেষে, ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’তে এসে থিতু হলেন কবি।

আর একবার, গৌতম ঘোষের বাড়িতে আড্ডা দিতে গেছেন শক্তি। গৌতম ঘোষ তখন তরুণ পরিচালক। দুজনেই অল্পবিস্তর নেশায় আচ্ছন্ন। বাড়িতে ফিরলেন গৌতম ঘোষের বাবা। তিনি শক্তির পূর্বপরিচিত। শক্তি ভাবলেন, গৌতমের বাড়িতে আড্ডা দিতে এসেছেন বুঝি। তাঁকে সাদরে আমন্ত্রণ জানালেন। পরে যখন জানতে পারলেন তিনি গৌতমেরই বাবা, শক্তি অপ্রস্তুত। ‘শক্তিদা আমার বাড়িতেই আমার বাবাকে প্রায় নিমন্ত্রণ করে ফেলছিল’ – পরবর্তীকালে লিখেছেন গৌতম ঘোষ।

অভিনেতা অনিল চট্টোপাধ্যায়কেও একবার বেকায়দায় ফেলেছিলেন শক্তি। তাঁকে না জানিয়েই বার্নপুরের একটি অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে অনিলের নাম দিয়ে দিয়েছেন। সেই কার্ড নাকি বিলিও হয়ে গেছে সর্বত্র। শক্তি কথা দিয়ে বসে আছেন, অনিল চট্টোপাধ্যায় আসবেনই। অতএব তাঁর মান রাখতে অনিল হাজির হলেন সেই অনুষ্ঠানে।

আরও পড়ুন
ট্রামের ঘণ্টাও শুনতে পাননি জীবনানন্দ, মৃত্যুর আগে কমলালেবু খেতে চেয়েছিলেন একটা

শক্তি এমনই। খোলামেলা, উদ্দাম। তাঁর এই স্বভাবের জন্যে সহজে মিশেও যেতে পারতেন মানুষের সঙ্গে। অন্যদের বেকায়দায় ফেললেও, কেউই রাগ ধরে রাখতে পারেননি। কেননা লোকটি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। অসাধারণ প্রতিভাবান এক কবি। এবং সে-সময়ের বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিও বটে। মধ্যরাতে বাস চালিয়ে তাঁকে বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে যান কবিতামুগ্ধ বাস ড্রাইভার। তাঁর যাপনের অনুকরণ করতে গিয়ে নেশায় আচ্ছন্ন হয় অসংখ্য যুবক, অথচ শক্তির প্রতিভার ধারেকাছে পৌঁছোতে পারে না কেউ। কেননা, শক্তি এক ও অবিনশ্বর। তাঁর সৃষ্টি বা বিনাশ নেই। এক থেকে অপরে সঞ্চারিত হয় কেবল।

শক্তি চট্টোপাধ্যায় সঞ্চারিত হননি। তাঁর প্রতিভার যোগ্য উত্তরসূরি কি বাংলা সাহিত্য পেয়েছে আজও?

তথ্যসূত্র - 'শক্তির কাছাকাছি'

Powered by Froala Editor

More From Author See More