‘প্রতিষ্ঠিতদের দুর্বল লেখা একদম ছাপবে না’, উপদেশ দিয়েছিলেন নিত্য মালাকার

ওদিকে অনেকটা পথ হেঁটে এসে একটু ক্লান্ত হয়েছে আকাশ 

অথচ তার আঙুলের চিহ্ন দেখেই কচি মেঘেদের যাত্রা শুরু হয় 

নিত্য মালাকার আমার কাছে সেই আকাশ, যাঁর অল্প আদরের সন্ধান পেয়েই আমার মতো কচি মেঘ বারবার ঘনীভূত হতে চেষ্টা করেছে এবং যথারীতি ব্যর্থ হয়েছে। সালটা মনে হয় ২০১৬! মানস চক্রবর্তীর আন্তরিক আমন্ত্রণে আমাদের সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া ‘ইক্ষণ’ কোলে করে আমি আর সম্পর্ক মণ্ডল দুরুদুরু বুকে চলে গিয়েছি কোচবিহার লিটল ম্যাগাজিন মেলায়। সেই আমার প্রথম উত্তরবঙ্গ যাত্রা। স্বভাবতই ভয়, জড়তা আর কুঁকড়ে যাওয়া ছিল ভীষণ রকম। একদিকে প্রথম উত্তরবঙ্গ যাত্রার বিহ্বলতা আর অন্যদিকে একসঙ্গে এত কবিদের লেপ্টালেপ্টি দেখে ক্রমাগত তুবড়ে যাচ্ছি। এর মধ্যেই ব্যানার টাঙানো, বইপত্র নিয়ে আসা, স্টল সাজানো ইত্যাদি হাজার হুজ্জুতে সকাল দুপুরে গড়িয়ে গেল, দুপুর বিকালে। লোকজন ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে। ইক্ষণের স্টল সামলানোর পাশে পাশেই মঞ্চের উপর কবিতার স্মার্ট দাপুটে পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছি। মঞ্চমধ্যে ও মঞ্চের বাইরে রাজকীয় চলন ও বলন দেখে কবি শব্দটার উচ্চতা মেপে নিতে চেষ্টা করছি আর কেঁপে যাচ্ছি হালকা হিমে। পাপড়িদির(গুহ নিয়োগী) বারবার এসে বিভিন্ন গুণীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও শীতের হলুদাভ হল্কা এসে লাগছে গায়ে। আমার স্বভাবের বশেই যেন বিষণ্ণ লাগছে খুব, সিগারেট সঙ্গ চাইছে মন আর ক্রমাগত বয়ে চলেছে স্বভাববিরুদ্ধ হাওয়া। এদিকে সম্পর্ক ওই হাওয়া-বাতাসেই কোথায় মিশে আছে দেখতে পাচ্ছি না। আরও বেশ কিছুটা সময় স্বদম্ভে পেরিয়ে গেল, হাওয়ার গায়ে হেলান দিয়ে বিকাল গড়াল সন্ধ্যায়। মন আর টিকছে না। তাই অবশেষে ‘কালকণ্ঠ’ পত্রিকার সম্পাদক বাপ্পাদাকে স্টলটা একটু দেখতে বলে সম্পর্ক আর সিগারেটের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। যাত্রাপথেই সম্পর্কের সন্ধান পেলাম। সম্পর্ক পরিচয় করিয়ে দিল আকাশ রঙের পাঞ্জাবি পরে থাকা একজন মানুষের সঙ্গে যিনি প্রথম দর্শনেই ‘আমার এলাকার ছেলে’ বলে জাপটে ধরলেন তাঁর বুকে, যে বুকে আমি ঝকঝকে একটা পরিষ্কার আকাশের রঙ দেখতে পেলাম। বলা বাহুল্য, এই আকাশ নিত্য মালাকার, এই রং নিত্য মালাকারের রং যা আমার জীবনে নিত্য ফুটিয়ে তোলে ফুল।

দানা ফসলের দেশে এসেছি আবেগে

আরও পড়ুন
‘বেঞ্চের ওপর ঐ ছাতাটি রয়েছে’ – তক্ষুনি লিখে দিলেন বিনয়; হারিয়ে গেছে সেই কবিতাও

দেখেছি কিছুটা অন্ধ পটুবাক আমাদেরই পাখি 

অন্তরালপ্রিয়, ঠোঁটে খুঁটছে ডালিম

আরও পড়ুন
ভূমির কাছেই ফিরতে চেয়েছিলেন কবি বীতশোক ভট্টাচার্য

ব্যক্তি নিত্য মালাকারকে সেই এক আশ্চর্য হাওয়ার রাতে দেখেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি। কখনো খাবারের দোকানের সমস্ত বিল তিনি একাই মিটিয়ে দিচ্ছেন অন্নপূর্ণার মতো, আবার কখনো কবি সুদীপ্ত মাজির রসিকতায় শিশুর মতোই লুটিয়ে পড়ছেন হাসিতে। সুদীপ্ত মাজি জিজ্ঞেস করছেন "নিত্যদা, এই নিত্যদা তোমাকে নিয়ে রবীন্দ্রনাথ গান লিখেছেন তুমি জানো?" তিনি অবোধ শিশুর মতো জিজ্ঞেস করছেন "আমাকে নিয়ে?" সুদীপ্ত মাজি গেয়ে উঠছেন "নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে"। লজ্জায় নত হয়ে তিনি বলছেন - "এই সুদীপ্ত কী সব বলে না!" উল্টোদিকে সেই লাজুক মানুষটাই আমার দ্বিধা, লজ্জা ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে সিগারেট গুঁজে দিচ্ছেন হাতে। কাউন্টার নিতে নিতে বলে উঠছেন "জানো, এই কোচবিহার আমার হাতের তালুর মতো চেনা, দিনের পর দিন আমি আর অরুণেশদা এখানকার গলি গলি ঘুরে বেড়িয়েছি, এখানকার রেড লাইট এরিয়ায় টহল দিয়েছি।"আবার রাতের সেই তুমুল উত্তেজনাপূর্ণ আড্ডার মধ্যেই সম্পর্ক প্রকাশ্য আড়ালে স্মার্টলি রেকর্ড করে নিচ্ছে কবির সঙ্গে কথোপকথন, যেখানে তিনি বলছেন "ছন্দের কানটা খুব জরুরি।" তিনি শব্দ ও প্রকৃতিনিহিত ছন্দের, সুরের প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করে নিচ্ছেন প্রথাগত ছন্দের বদলে। তাঁর লেখার মধ্যেও প্রথাগত ছন্দবিহীন এক সুরের প্রাধান্য নজর করতে বলছেন। কিন্তু এও মনে করিয়ে দিচ্ছেন পদ্য নয়, গদ্যই কবিতার উপযুক্ত বাহন - "টানা পদ্যে তোমাদের আর ধরে রাখতে পারছি না বলেই এই কপটতা বেছে নিলাম।" কিন্তু আমার স্বল্প অভিজ্ঞতায় তাঁর মতো এত অকপট মানুষ আমি খুব কম দেখেছি। অকপট এক সত্তার অধিকারী ছিলেন বলেই তিনি বলতে পেরেছেন -

“সব ভালো কবিতাই পূর্বজরা লিখে গেলেন বলে আমি আর ও পথে গেলাম না আজ। বরং সারাদিন ধরে পণ্ডিতমশাইয়ের নস্যডিব্বা সংগ্রহ করলাম। আর মাকড়সাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে ক-জনের ছাদে অ্যান্টেনা আছে, হিসাব নিলাম। ফড়িঙের মা আমার মাসি ছিল, এরকম ভাবলাম। সদর্থক সমস্ত শব্দই তো রবীন্দ্রনাথ আর সংবিধানে লেখা আছে। আর কেন, আমি তবে এবার ঘুমোব।"

আরও পড়ুন
বইটি ‘বান্ধবীকেন্দ্রিক’, বারবার নাম বদলেছেন বিনয় মজুমদার

লজ্জার সঙ্গে জানাই, তখনও আমি কবি নিত্য মালাকারকে চিনি না (আজও কি চিনি?) কিন্তু ব্যক্তি নিত্য মালাকারের দু'হাত বাড়ানো আলিঙ্গন, তাঁর সন্ন্যাসীরাজার মতো চলন ও বলন, তাঁর কাউন্টার করা সিগারেট আমার সেই রাতের শীত ও বিষাদকে একযোগে স্টেডিয়াম পার করে দিয়েছিল।

বাড়ি ফিরে এসে কবি নিত্য মালাকারে অবগাহনের স্পর্ধা দেখাতে গিয়ে তলিয়ে গেলাম। ‘অস্ট্রিক’ প্রকাশিত তাঁর কবিতা সংগ্রহ আমাকে আছাড় মারতে লাগল ক্রমাগত। আমি খাবি খেতে লাগলাম উথাল পাথাল ঢেউয়ে। যেভাবে অস্তিত্ববাদ আর মরবিডিটি হাত ধরাধরি করে চলেছে তার লেখায়, যেভাবে শব্দ ও রুপের খাঁচা ভেঙে রীতিহীন জটিল ইঙ্গিতময় গদ্যে তাঁর কবিতাভুবনের এক একটি ইঁট গেঁথেছেন তিনি, তাতে আমার স্বল্প জীবনের কবিতা সম্পর্কিত সামান্য সঞ্চয় টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তাঁর বাগানে আমি অন্ধের মতো প্রবেশ করে আলোর সন্ধান পেলাম ঠিকই কিন্তু সে আলোর মর্ম উদ্ধার করতে পারলাম না। আমার প্রশিক্ষণহীন চেতনা আমাকে লজ্জা দিতে লাগল ক্রমাগত। 

অনেক বলার ছিল, কিন্তু এই প্রতিহাওয়া....

আমি কীভাবে কলম ধরব ভয় হয়, বিভিন্ন শব্দে শিল্প, অনুরাগ 

নিয়ন্ত্রণ সহজসাধ্য কি হবে? আমি ভাবি,নাহ্-

কিছুই বলব না;

বরং এসো ভাতের গল্প করি-কী কী খেলুম এ-জীবনে....

আমি কিছুই বলবো না পাছে ইন্ধন উসকে বা ভিজে যায়, 

বাংলা কবিতায় রীতিহীন যে রেওয়াজ তিনি তৈরি করেছিলেন তার সম্পর্কে আমার মতো তৃণের বলতে যাওয়া এক ধৃষ্টতা। তাঁর ব্যঞ্জনায় বিবশ হয়ে এই স্বতন্ত্র সম্রাটের সামনে বরং টুপি নামিয়ে রাখি, মাথা ঝুঁকিয়ে নিয়ে চলে যাই ব্যক্তিগত স্মৃতির কাছে যেখানে আলো আর অক্ষরেখা। 

ক্রমশ পান্তা আনতে দিন ফুরিয়েছে আরও। নিজস্ব ভাত-ডালে মগ্ন হয়ে সময় বয়ে যাচ্ছে স্রোতের প্রতিকূলে, আর ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো বিদ্রুপ ঝরে পড়ছে জীবনে। এমনই একটা দিনে সম্পর্ক ফোন করে বলল নিত্য মালাকার ফোন করেছিলেন, অনেক কথা হল, তোমাকে ফোন করতে বললেন। তড়িঘড়ি ছাদে উঠে ফোন করে পরিচয় দিতেই বলে উঠলেন "তোমরা খুব পাজি ছেলে, সেই যে গেলে তারপর থেকে আর পাত্তা নেই।" পত্রিকা পড়ে ভালো লাগার কথা জানালেন এবং দিলেন প্রয়োজনীয় শিক্ষা - "প্রথম কাজ হিসেবে তোমরা যা করেছ অনেকেই করতে পারে না। তবে একটা কথা বলার, তরুণদের দুর্বল লেখা ছাপা যায় কিন্তু প্রতিষ্ঠিতদের খাজা লেখা একদম ছাপবে না।"

ইতিমধ্যেই তাঁর কবিতা সংগ্রহ পড়ে ফেলেছি এবং আবেগবশত তাঁকে নিয়ে লিখে ফেলেছি দু-একটা অক্ষর কিন্তু সাহস হয়নি সে কথা বলার। লজ্জায় গুটিয়ে গেছি। বারবার বলতেন কাটোয়া যাব, ভেবেছি যখন দেখা হবে আবার, টুক করে লেখাটি দিয়ে দৌড়ে পালাব কিন্তু সেই সুযোগ আর আসেনি। এখনো মনে আছে শেষ সেই ফোন, মাঝে মাঝেই কাশির দমক আসছিল আর তিনি বলে চলেছিলেন কীভাবে জড়িয়ে পড়েছিলেন রাজনৈতিক আন্দোলনে, নবদ্বীপ ছেড়ে চলে গেছিলেন খলিশমারি। সেখানে স্কুল পড়ানো আর টিউশন নিয়ে কাটছিল জীবন আর লেখালেখি। টিউশনের যৎসামান্য মাইনেও অনেকে দিতে পারত না। তার বদলে দিয়ে যেত চাল, আলু, সবজি, পেঁয়াজ। নিরানন্দ বিচ্ছিন্ন এক জীবনকে তিনি ধীরে ধীরে কীভাবে আনন্দবাজারে রূপান্তরিত করেছিলেন শুনতে শুনতে গালে উষ্ণ জলরেখা নামছিল আমার আর আফসোস হচ্ছিল কেন এই কল রেকর্ড করে রাখলাম না, এই কল কি রেকর্ড করা উচিত ছিল? তারপর কাশির প্রকোপ বেড়ে চলায় মাঝপথেই সমাপ্ত হয়ে গেল কল আর সমাপ্ত হয়ে গেল সব যোগাযোগ। অসুস্থতা বেড়ে যাচ্ছিল দিন দিন, ফোন করতে চেয়েছি কিন্তু ব্রহ্মজিতের(সরকার)  কাছে শুনি ওঁর কথা বলতে কষ্ট হয়, কথা বলতে পারেন না ঠিকমতো, তাই ফোন আর করিনি, ভেবেছি যাব একবার। কিন্তু সে যাত্রা আর পূর্ণ হল না। আজ নয় কাল করতে করতে মানুষটার আয়ুস্কাল শেষ হয়ে গেল যেদিন, প্রথম বার কোনো কবির জন্য খুব কেঁদেছিলাম। সমস্ত আয়নার কাচগুলো সেদিন চুরমার করে দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল কারণ ওই কাচের স্বচ্ছতায় অন্য কারো নয়, আমারই মুখ অপদার্থ অপরাধীর মতো ফিরে ফিরে আসছিল।

Powered by Froala Editor

More From Author See More