মৃতদেহের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করত গ্রিকরা, দেবতাদের মধ্যেও প্রচলিত ছিল এই রীতি

যুদ্ধ মৃত্যু আর ব্যাভিচার, তার মধ্যেই সুন্দরের আরাধনা -- এই নিয়ে অন্ধ কবি হোমারের দুই বিরাট মহাকাব্য ইলিয়াড আর ওডিসি। আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতকে এই কাহিনীর অবতারণা হয়েছিল বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। পাশ্চাত্যের প্রাচীনতম এই দুই মহাকাব্যের প্রতিপাদ্য গ্রিস আর ট্রয়ের রাজনৈতিক সম্পর্ক। থাক সে কাহিনী। তবে এর মধ্যেই একটি ঘটনা হয়তো অনেকের নজর এড়িয়ে যায়। দুই দেশের দুই রাষ্ট্রনায়ক এখানে নিজেদের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করেছেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে। হ্যাঁ, ঠিক আজকের মানুষের মতোই তাঁরা পরস্পরের আনুগত্য প্রকাশের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই সংকেতটি।

আজ থেকে বহু বহু বছর আগে, যখন পৃথিবীতে কোনো সর্বজনগ্রাহ্য ভাষার অস্তিত্ব ছিল না, তখনও বিভিন্ন দেশের মধ্যে চলত রাজনৈতিক বিনিময়। আর এসবের জন্য মৌখিক কথার থেকে তাঁরা চিহ্ন ভাষা বা সাইন ল্যাংগুয়েজের উপরেই ভরসা রাখতেন বেশি। আর এভাবেই নানা সংকেতের জন্ম হয়, আজকে যেসব চিহ্ন আন্তর্জাতিক এটিকেটে পরিণত হয়েছে। অবশ্য পৃথিবীর ইতিহাসে এমন অনেক ঘটনা ঘটে, যার ফলে বদলে যায় অনেক সামাজিক ব্যবহার। ঠিক যেমন সম্প্রতি করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বদলে দিচ্ছে অনেক কিছু। কোনো পরিচিত বা অপরিচিত ব্যক্তির সঙ্গে কোনরকম শারীরিক স্পর্শ ঘটাতে চাইছেন না কেউই। ফলে হ্যান্ডশেকের অভ্যাসও বন্ধ হয়ে গিয়েছে। হয়তো এবার ইতিহাসে পরিণত হবে এই সংকেত। তবে ঠিক কত পুরনো ইতিহাস? সেকথা সঠিকভাবে বলা মুশকিল। লিখিত ইতিহাসের জন্মের অনেক আগেই এই প্রথার জন্ম। নানা সাহিত্যে, শিল্পে এবং কাহিনিতে ছড়িয়ে আছে তার নমুনা।

গ্রিসের দেবতাদের রাজা জিউস আর সংস্কৃতির দেবী এথিনা দীর্ঘদিন পরস্পরের শত্রু ছিলেন। অবশেষে সেই শত্রুতা মিটিয়ে নিয়ে পরস্পর সন্ধি স্থাপন করেছিলেন। প্রাচীন গ্রিসের পুরাণের এই কাহিনি অনেক শিল্পের প্রতিপাদ্য বিষয়। এথেন্সের অ্যাক্রপোলিস মিউজিয়ামে সংরক্ষিত একটি প্রাচীন স্তম্ভের পাদদেশে খোদিত আছে সেই কাহিনিই। আর তাতে দেখা যাচ্ছে জিউস এবং এথিনা সন্ধি স্থাপন করেছেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে।

শোনা যায় খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিসের মৃত মানুষদের সমাধির আগে পরিবারের মানুষরা মৃতদেহের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করতেন। প্রয়াত সদস্যের সঙ্গে পরিবারের চিরন্তন বন্ধনের প্রকাশ ছিল এই রীতি। হয়তো ভবিষ্যতে সেই প্রেতাত্মা যাতে পরিবারের কারোর কোনো অনিষ্ট না করে, তাই এক সন্ধি স্থাপনের ব্যবস্থা হিসাবেও গৃহীত হয়েছিল এটি।

হ্যান্ডশেকের ইতিহাস ঠিক কত পুরনো, সে-কথা নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব নয়। তবে সবচেয়ে প্রাচীন যে উদাহরণটি পাওয়া যায়, সেটি একটি প্রস্তরক্ষণ্ডে খোদিত। উনিশ শতকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে খুঁজে পাওয়া এই প্রস্তরক্ষণ্ডটির বয়স আনুমানিক তিন হাজার বছর। আসিরিয়ার সম্রাট তৃতীয় শালম্যানেশারের রাজদরবারের নথি বলে মনে করা হয় এটিকে। এই প্রস্তরচিত্রে দেখা যাচ্ছে আসিরিয়ার সম্রাট এবং ব্যাবিলনের সম্রাট সন্ধি স্থাপন করছেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে।

তবে সারা পৃথিবীব্যাপী এই রীতি জনপ্রিয় হতে বেশ সময় লেগে গিয়েছিল। মনে করা হয় ষোড়শ অথবা সপ্তদশ শতকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের জলদস্যুদের হাত ধরেই ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে এই রীতি। বাংলাতেও এই রীতি ওলন্দাজ জলদস্যুরাই নিয়ে এসেছিলেন বলে মনে করা হয়। পৃথিবীর নানা প্রান্তে এমন অনেক সাংকেতিক ভাষা আজও প্রচলিত আছে। নমস্কারের রীতি হোক বা কোলাকুলি অথবা চুম্বন, সবই কিন্তু একধরনের সাংকেতিক ভাষা। বহু বছর আগে মৌখিক ভাষার অভাব মেটাতেই এইসব সংকেত তৈরি করেছিল মানুষ। আজও আমাদের সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে সেসব মিলেমিশে আছে।

More From Author See More