বেরনো নিষেধ, অনলাইন পুজো-পরিক্রমাতেই আনন্দ খুঁজলেন নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা

“সেবছর আমার নিজের দাদু-ঠাকুমা বেশ কিন্তু কিন্তু করেই বললেন, তাঁরা দুর্গাপুজোর মণ্ডপ ঘুরে দেখতে চান। বয়সের ভারে তখন আর একা একা বেরোতে পারেন না। ফলে প্যাণ্ডেল হপিং-এর স্বাদ থেকে দীর্ঘদিন বঞ্চিত। তখনই মনে হল, এটুকু আনন্দের স্বাদ তো তাঁদের দেওয়াই যায়। বিশেষ করে বৃদ্ধাবাসের আবাসিকরা, যাঁদের সারাদিন ওই বাড়ির মধ্যেই কেটে যায়। ব্যাস, শুরু হয়ে গেল এভাবেই।” বলছিলেন রিয়েলটেক নির্মাণ সংস্থার কর্ণধার শিশির গুপ্ত।

সেটা ২০১০ সাল। কলকাতার বেশ কিছু বৃদ্ধাবাসের আবাসিকদের নিয়ে শুরু হল একসঙ্গে মণ্ডপ ঘুরে দেখানোর অনুষ্ঠান। দেখতে দেখতে একটা দশক পেরিয়ে একাদশ বছরে পা দিল সেই অনুষ্ঠান। তবে এ-বছর আয়োজন একটু অন্যরকম। “তাঁদের মণ্ডপ দেখানো যেমন কর্তব্য, তেমনই তাঁদের নিরাপত্তার কথাও তো আমাদেরই ভাবতে হবে। এই করোনা পরিস্থিতিতে বাইরে যাওয়া মানেই তো সংক্রমণের সম্ভাবনা। আর বয়স্ক মানুষদের ক্ষেত্রে তো সম্ভাবনা আরও বেশি। তাই আমরা ঠিক করেছিলাম, এবছর পরিক্রমা হবে অনলাইনে, অর্থাৎ ভিডিও স্ট্রিমিং-এর মাধ্যমে।” কলকাতা হাইকোর্ট তখনও প্রতিমা দর্শনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। শুরু হল অনলাইন পরিক্রমার প্রস্তুতি। “প্রত্যেক পুজো কমিটিই প্রতিবারের মতো এবারে সাহায্য করেছে আমাদের। সঙ্গে পুলিশের কনভয় ছিল, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা দেখার জন্য। আর সেইসঙ্গে আমাদের পুরো অনুষ্ঠানকে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত মধুর সঞ্চালনায় সাজিয়ে তুলেছেন সঙ্গীতশিল্পী সতীনাথ মুখোপাধ্যায়।”

প্রতি বছর পঞ্চমীর দিন ভলভো বাসে পুজো পরিক্রমার আয়োজন হয়। এ-বছরও পঞ্চমীর দিনেই অনলাইনে হল সেই অনুষ্ঠান। সকাল থেকে ছোটো ছোটো দলে ভাগ হয়ে প্রতিনিধিরা চলে গিয়েছিলেন ১৩টি বৃদ্ধাবাসে। তাঁদের হাতে তুলে দিয়েছেন বিশেষ গিফট প্যাক। আর ফেসবুক লাইভের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হল পুজো পরিক্রমার অনুষ্ঠান। “তবে এবারের অনুষ্ঠান শুধু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য নয়। ছোটো থেকে বড়ো সবাই ফেসবুকের মাধ্যমে এই অনুষ্ঠানের শরিক হতে পেরেছেন। আর এবারে তো সবাই বন্দি। সবাই তো মণ্ডপ পরিক্রমার স্বাদ থেকে বঞ্চিত।” ভার্চুয়াল পরিক্রমার পাশাপাশি বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য ছিল বিশেষ ক্যুইজের ব্যবস্থাও। “অনলাইন পরিক্রমার প্রস্তাব দেওয়ার পরেই ৮০০ জনের বেশি রেজিস্টার করিয়েছিলেন। কিন্তু বাস্তবে আরও অনেক মানুষ এই অনুষ্ঠানের সাক্ষী থেকেছেন।” ক্যুইজ অনুষ্ঠানের সঠিক উত্তরদাতাদের হাতেও তুলে দেওয়া হয়েছে বিশেষ গিফট ভাউচার।

১০ বছর সফলভাবে পুজো-পরিক্রমার আয়োজন করে এই করোনা পরিস্থিতিতেও দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারেনি আয়োজক সংস্থাটি। বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মুখের আনন্দের হাসিটুকুই তো মূলধন। আর এর উপর ভিত্তি করেই আগামী বছরগুলিতেও এগিয়ে যাবে এই উদ্যোগ। হয়তো আগামী বছর থেকে আবারও শহরের রাস্তায় নামবে বাস। আর তাতে সওয়ার হয়ে বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা একটার পর একটা মণ্ডপে ভিড় জমাবেন। একসময় যাঁরা বর্তমান যুব সমাজের হাত ধরে মণ্ডপ ঘুরে দেখিয়েছেন, এখন তারই প্রতিদান দেওয়ার সময়। একটু ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শই তো বদলে দিতে পারে একাকিত্বের অবসাদে ক্লান্ত মানুষগুলির মানসিক অবস্থাকে।

আরও পড়ুন
অষ্টমীর বেলুড় মঠ; ‘জ্যান্ত দুর্গা’ সারদামনির পুজো করলেন বিবেকানন্দ

Powered by Froala Editor