সমকালকে সর্বকালের হাতে সঁপেই বিদায় নিলেন হাসান আজিজুল

“বাংলা ভাষাকে যখন আমরা সার্বিক সংকটের হাত থেকে বাঁচাতে চাই, তখন তো শুধু রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে চাহিদা মেটে না। ভাষাকে তার ওজনে শক্তিশালী করতে হয়।” বলছিলেন সাহিত্যিক প্রচেত গুপ্ত। বাংলা ভাষার এই ওজন যাঁরা বাড়িয়েছেন, তাঁদের মধ্যে হাসান আজিজুল হক নিঃসন্দেহে অন্যতম একজন শিল্পী ছিলেন। সার্থক অর্থেই শিল্পী, যিনি জীবনের বাস্তবতা থেকে শুধু বিষয়বস্তুকেই তুলে আনেননি, বরং তার সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছেন গল্পের কাঠামোকেও। অথচ এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি সাহিত্যচর্চা শুরু করেছেন, বিষয় ও আঙ্গিককে আলাদা করে দেখাই যেন তখন কর্তব্য। হাসান আজিজুল হক (Hasan Azizul Huq) সেই পথে হাঁটেননি। আবার ঐতিহ্যের কলুর বলদ হয়েও থাকেননি। বরং প্রতিদিনের জীবন থেকে উঠে আসা বিষয়বস্তুই ঠিক করে দিয়েছে তাঁর লেখার আঙ্গিক কেমন হবে।

সাহিত্যিক কণিষ্ক ভট্টাচার্যও বলছিলেন, “সব শিল্পীরই তো নিজস্ব একটি শৈলী থাকে। হাসান আজিজুল হকেরও ছিল। এমন একটা শৈলী ছিল, যা পাঠকদের ভালো লেগেছে। আবার আমাদের মতো অনুজ সাহিত্যিকদের প্রেরণাও জুগিয়েছে।” তার কারণ সম্ভবত এটাই, হাসান আজিজুল হকের লেখা সমষ্টির প্রতিনিধিত্ব করে। সেখানে সাধারণের ব্যপ্তি, কিন্তু ব্যতিক্রমীরা রয়েছেন ক্ষুদ্র পরিসরে। অথবা একেবারেই অনুপস্থিত। আবার সমষ্টির মধ্যেও ব্যক্তির স্বাতন্ত্র প্রবল। তাই কোনো নির্দিষ্ট পথে মুক্তির হদিশ দিতে চান না তিনি। প্রথম প্রকাশিত গল্প ‘শকুন’-এই সেটা স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আগাগোড়া শোষণের গল্প ‘শকুন’। কিন্তু তার বিপরীতের যে প্রতিক্রিয়া, সেখানে মানুষ বাস্তবের মতোই অসহায়। আবার এই অসহায় মানুষরাই পরে মুক্তিযুদ্ধের নিশান হাতে তুলে নিয়েছেন। তখন স্বপ্নের দীপ্তিও কোথাও কম নয়। এই আলো-আঁধারি পথেই ৬ দশক ধরে এগিয়ে চলেছে হাসান আজিজুল হকের কলম।

‘অভিজ্ঞতা’ – এই একটি বিষয়ের ওপর চিরকাল জোর দিয়েছেন তিনি। অভিজ্ঞতাই তাঁকে পাঠকদের কাছাকাছি এনেছে। আবার নিন্দিতও হয়েছেন একই কারণে। তাঁর জীবনের অভিজ্ঞতাই যে দেশ-কাঁটাতারের সীমানা মানেনি। বর্ধমানের গ্রামে বেড়ে ওঠা ছেলেটি যখন মানচিত্রের সীমানা পেরিয়ে রাজশাহী শহরে হাজির হয়, তখন তার অভিজ্ঞতাতে এই দুই বাস্তব মিলেমিশে যাওয়াই স্বাভাবিক। তাই আদ্যন্ত বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সাহিত্য রচনা করেও তাঁকে শুনতে হয়েছে, তিনি রাঢ় বঙ্গের জীবনকে ছাড়তে পারেননি। সত্যিই কি ছাড়তে পেরেছিলেন? শঙ্খ ঘোষের কাছে তাঁর ‘আগুন পাখি’ উপন্যাসের কথা জানতে পেরে যখন দে’জ পাবলিশিং-এর প্রকাশক শুভঙ্কর(অপু) দে তাঁর কাছে যান, বিনা বাক্যব্যয়ে এপাড় বাংলায় বই প্রকাশে রাজি হয়ে যান তিনি। শুভঙ্কর বলছিলেন, “আমরা তাঁকে নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম আমাদের বর্ধমানের শাখায় একবার পা রাখতে। তিনি সানন্দে সেই নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন, দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন সেখানে।” কলকাতা থেকে তাঁর বই প্রকাশের সময় বরাবর উত্তেজিত হয়ে থাকতেন। দেরি হলে তাগাদা দিতেন বারবার। এমনই অভিজ্ঞতার কথা জানালেন শুভঙ্কর।

সাহিত্য জীবনের শুরু থেকে কেন ছোটো গল্পই লিখে গেলেন হাসান আজিজুল? কেন আবার শেষ সময়ে এসে কলম ধরলেন উপন্যাস লিখতে? কেন মনে হচ্ছিল, গল্প থেকে তিনি দূরে সরে যাচ্ছেন? এর কোনো উত্তরই জানতেন না তিনি। তবে অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারকে উজাড় করে দিতে চেয়েছিলেন বরাবর। টলস্টয়ের মতো তিনিও তো বিশ্বাস করতেন, উপন্যাসের আড়ালে আসলে প্রত্যেকেই আত্মজীবনী লেখেন। তবে সেই অভিজ্ঞতার ঝুলি সম্পূর্ণ উজাড় করে দেওয়া হল কি? নাকি আদৌ তা শেষ হয়? জীবনের সঞ্চয় খরচাপাতি হয়ে যায় কিছু। তবুও মৃত্যুর সময় মানুষ পুরোপুরি নিঃস্ব নন। কণিষ্ক ভট্টাচার্য বলেন, “অক্ষরশিল্পী হিসাবে এটুকুই চাইব, আমাদের ব্যক্তিগত আবেগের জায়গা থেকে নয়, বরং হাসান আজিজুল হক যেন ভবিষ্যতের কাছে থেকে যান তাঁর সাহিত্যের জোরেই।” সেই সাহিত্য যে একেবারে সমকালের সাহিত্য, তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু সমকালকে সর্বকালের করে তোলার দায় লেখকেরই – বিশ্বাস করতেন হাসান আজিজুল। আর তাই প্রচেত গুপ্ত মনে করেন, “তিনি চলে যাননি। তিনি আসলে আমাদের মধ্যে থেকেই গিয়েছেন।”

আরও পড়ুন
সাহিত্যজগতে নক্ষত্রপতন, প্রয়াত হাসান আজিজুল হক

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
‘কচু ঘেঁচু’ জোটে দুর্গার কপালে! কবিতা ফাঁদলেন বঙ্কিম

More From Author See More