ভিটেমাটি হারিয়ে আবার উদ্বাস্তু জীবন? বাংলায় বাড়ছে এনআরসি-আতঙ্ক

তন্নতন্ন করে খুঁজছেন আলমারি। নেই। তাকের ওপর থেকে নামিয়ে আনলেন জং-ধরা ট্রাঙ্ক। ডালা খুলে, তোলপাড় করলেন পুরনো কাপড়চোপড়, কাগজ। নাহ, যা চাইছেন, তেমন কিছুই পাওয়া গেল না। আদৌ ছিল কিনা, জানেন না তাও। তবু আশা, কিছু যদি পাওয়া যায়! দু’একটা প্রমাণ, কিছু পুরনো নথি। এদেশে থাকতে গেলে, এসবের বড্ড প্রয়োজন আপনার।

অথচ কখনও ভাবেনইনি, এমনও দিন আসতে পারে। এতগুলো বছর কেটে যাওয়ার পর, হঠাৎ একদিন শুনতে হতে পারে – ভারত আপনার দেশ নয়। যেমন হয়েছে আসামে। যেমনটা পশ্চিমবঙ্গেও হবে – এমন বলে চলেছেন বিজেপির কিছু নেতা। এনআরসি। খায় না মাথায় দেয়, তা আপনার জানার প্রয়োজন নেই। আপনি শুধু এটুকু জানেন, পশ্চিমবাংলায় এনআরসি চালু হলে প্রশ্ন উঠবে আপনাকে নিয়েও। সেই কোন আমলে আপনার বাবা কিংবা ঠাকুরদা ওপার বাংলা থেকে চলে এসেছিলেন এখানে, এসে হাজার কষ্টের পর তিল-তিল করে তৈরি করেছিলেন এই বাড়ি, এই নিশ্চিন্ত আশ্রয়টুকু, এবার সেটাও কেড়ে নিতে চাইছে রাষ্ট্র। আগের প্রজন্মের মতো আরও একবার উদ্বাস্তু হতে হবে আপনাকে। উত্তরাধিকার?

আরও পড়ুন
অখণ্ড থাকুক বাংলা, চাননি নেহরু-প্যাটেল-শ্যামাপ্রসাদ

শোনা যাচ্ছে, এনআরসি-র হাত থেকে বাঁচতে গেলে ১৯৭১-এর আগেও যে আপনি ভারতে থাকতেন, সেই প্রমাণ দেখাতে হবে। আশ্চর্য এক পরিস্থিতি। পঞ্চাশ বছর আগেকার কাগজপত্র এখন কোথায় পাবেন আপনি? হয়তো সে-সময় তৈরিই হয়নি কোনো বৈধ কাগজ। হয়তো বন্যায়, আগুনে কিংবা বাড়ি বদলাতে বদলাতে হারিয়ে গেছে সেই নথি। এতদিন পর হঠাৎ যদি কেউ আপনার নাগরিকত্বের প্রমাণ চায়, কোথায় পাবেন আপনি?

আরেকটি গুজব শোনা গিয়েছিল কয়েকদিন। পশ্চিমবাংলার ক্ষেত্রে এনআরসি নাকি লাগু হবে ১৯৪৮ থেকেই। তাই যদি হয়, তাহলে প্রতি তিনজনে একজন মানুষ ‘বিদেশি’ বলে গণ্য হবেন। এককথায়, যাঁরা ওপার বাংলা থেকে এখানে এসেছেন, তাঁদের পক্ষে এখানকার ১৯৪৮-এর আগে ‘বর্তমান’ ভারতে বসবাসের প্রমাণ দেখানো অসম্ভব। যারা পশ্চিমবঙ্গের আদি বাসিন্দা, তাঁরাও কি যত্ন করে রেখেছেন তিয়াত্তর বছর আগেকার সেসব নথি?

ইতিমধ্যেই এনআরসি-আতঙ্কে মৃত্যু হয়েছে অনেকের। আত্মহত্যাও করেছেন বেশ কয়েকজন। কেউ হয়তো পুরনো নথি খুঁজে পাননি, কেউ আবার আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন ভোটার কার্ডে নামের বানানভুলের জন্য। কারও হয়তো হারিয়ে গিয়েছে ভোটার কার্ডই। ফলে, দেশছাড়া হওয়ার ভয় চেপে বসেছে তাঁদের মনে। ভিটেমাটি হারালে পরিবার-পরিজন নিয়ে কোথায় দাঁড়াবেন তাঁরা? এই দুশ্চিন্তার সমাধান হিসেবে তাঁরা বেছে নিচ্ছেন আত্মহত্যার পথ। পাশাপাশি, বিডিও অফিস, রেশন অফিস ও অন্যান্য সরকারি দপ্তরে বাড়ছে লাইন। মানুষকে যেনতেন প্রকারেণ প্রমাণ করতেই হবে, মহান ভারতবর্ষের সুনাগরিক তাঁরা। নইলেই গলাধাক্কা। সীমান্ত-ঘেঁষা জেলাগুলিতে এই আতঙ্ক বেশি। উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, মুর্শিদাবাদ, নদিয়ার মানুষ, যাঁরা দেশভাগের পর সহায়সম্বলহীন হয়ে এসেছিলেন পশ্চিম বাংলায়, আতঙ্ক গ্রাস করছে তাঁদের। কলকাতা ও মফঃস্বলের তথাকথিত মধ্যবিত্তদের ভেতরে এখনও দেখা যায়নি ভয়ের সেই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু ভেতরে-ভেতরে আতঙ্কিত তাঁরাও। কী হবে, যদি এখানেও চালু হয় এনআরসি? ১৯৭১-এর আগেকার কাগজপত্র কী কী হওয়া সম্ভব? রেশন কার্ড? বাড়ির দলিল? ইলেকট্রিক বিল? অতএব, তোলপাড়...

এমন অনেকে আছেন, যাঁরা ১৯৪৭-এর অব্যবহিত পরেই চলে এসেছেন এপারে। তারপর দিন কেটেছে বিভিন্ন ক্যাম্পে, ভাড়াবাড়িতে। সে-আমলের নথি কই? যদি রেশন কার্ড হয়েও থাকে, এত বছর পর তা পাওয়া মুশকিল। নিজের বাড়ি হলে তাও নিশ্চিন্তি। পৌরসভায় অন্তত সে-সংক্রান্ত কাগজপত্র থাকবে। জমির দলিলেও লেখা থাকবে তারিখ। নইলে? ঘোর বিপদ। কেউ যদি নিজস্ব বাড়িটুকু তৈরি করেন ১৯৭১-এর পরে, তাহলে তাঁর কী হবে? এনআরসি আইন অনুযায়ী তাঁর তো নাগরিকত্ব থাকাই উচিৎ নয়!

অনেকের এপারে আসা আবার ১৯৭১-এর পরে। তাঁদের আতঙ্ক সবচেয়ে বেশি। যদি পরবর্তী প্রজন্ম ভারতে জন্মগ্রহণ করে, ১৯৭১-এর পরেও, রেহাই নেই। কেননা আপনাকে দাখিল করতে হবে ১৯৭১-এর আগে আপনার পূর্বপুরুষ ভারতেই থাকতেন – এমন প্রমাণ। নইলে আপনার জন্ম ১৯৯০ সালে হলেও লাভ হবে না কিছুই। বাপ-ঠাকুরদার ডকুমেন্ট লাগবে সেক্ষেত্রে।

রাজ্যের সরকারের তরফে বারবার আশ্বস্ত করা হচ্ছে, এনআরসি পশ্চিমবঙ্গে চালু হবে না কিছুতেই। অথচ অপরপক্ষের সদর্প ঘোষণা – তাঁরা ক্ষমতায় এলে এনআরসির হাত থেকে বাঙালিদের বাঁচাতে পারবে না কেউই। ‘বিদেশি’দের চিহ্নিত করে একে একে তাড়ানো হবে। কোথায়? বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছে, ভারত কাউকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করলেও তারা তাদের গ্রহণ করবে না। তাহলে? গতি সেই ডিটেনশন ক্যাম্প। মানবেতর জীবন। বন্দির মতো কাটানো একটার পর একটা দিন।

এনআরসি-সমর্থনকারী নেতাদের বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হলে এখানকার হিন্দুদের কোনো ক্ষতি হবে না, বহাল তবিয়তে থাকতে পারবেন তাঁরা। কিন্তু মুসলমানরা, যাঁরা দেশভাগের পর এসেছিলেন ওপার থেকে, তাঁদের চিহ্নিত করে তাড়ানো হবে একে একে। প্রথমত এই কথাটিই গণতন্ত্র ও সংবিধানবিরোধী। একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে এভাবে হিন্দু-মুসলমান বিভাজন করাই অন্যায়। কিন্তু তাতে মদত দিয়ে চলেছেন কেন্দ্রীয় সরকারের আশীর্বাদধন্য নেতারা। তাঁদের মতে, দেশভাগ যেহেতু ধর্মের ভিত্তিতে হয়েছিল, এনআরসি-তে নাগরিকত্বও বাদ যাবে ধর্মপরিচয়ের কারণেই।

অর্থাৎ, ১৯৪৭-এর ট্র্যাজেডির ইতিহাস আবার ফিরিয়ে আনব আমরা। ধর্মের ভিত্তিতে বাতিল হবে নাগরিকত্ব। বেশ। কিন্তু সামান্যতম ইতিহাস-সচেতন হলে সেই নেতারা জানতেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় খানসেনাদের আক্রমণের ভয়ে হিন্দুদের পাশাপাশি অনেক মুসলমানও শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে। আশ্রয় দিয়েছিল ভারত সরকারই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর, অনেকে ফিরে গেছেন, কেউ কেউ যাননি। থেকে গেছেন পশ্চিমবঙ্গেই। কারণ পশ্চিমবঙ্গের ভাষা, সংস্কৃতি ও মানুষজনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয়নি তাঁদের। নেতারা ভুলে যান যে, বাংলা ও বাঙালির ইতিহাসের বয়স তিয়াত্তর বছর নয়। হাজার-হাজার বছর ধরে গড়ে উঠেছে এই সংস্কৃতি। পশ্চিমবঙ্গ ও বাংলাদেশের মধ্যে যেটুকু পার্থক্য, তার যতটা না স্বাভাবিক, তার চেয়ে অনেক বেশি আরোপিত। রাজনৈতিক কারণে তৈরি করা চরিত্র। ধর্মের কারণে মূল আচারের ফারাকটুকু বাদ দিলে, বিশেষ পার্থক্য খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেখানে এনআরসি-সমর্থকরা পঞ্চাশ বছর আগে ওপার বাংলা থেকে এপারে আসা একজন মানুষের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, অভ্যস্ত জীবনযাত্রাকে অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এখনকার মানসিক পীড়নের ফল তো আমরা দেখছিই! রোজ একের পর এক আত্মহত্যার খবর। সত্যি-সত্যি এনআরসি চালু হলে, বাংলা শান্ত থাকবে তো?

ওপার বাংলার ভিটে ছেড়ে বাপ-ঠাকুরদা এসেছিলেন এপারে। তিলে-তিলে গড়ে তুলেছেন বসত, দরমার বেড়া খড়ের চাল থেকে আস্তে আস্তে পাকা হয়েছে দেওয়াল। মাথার ওপর নিশ্চিন্ত হয়েছে ছাদ। ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে যাচ্ছে, আপনার নিজের জীবনও আপাতত খানিক স্থির। একদিনে হয়নি এতকিছু। সত্তর বছর লেগে গেছে এই অবস্থায় আসতে। কারো ক্ষেত্রে পঞ্চাশ বছর। কেউ এখনও সুস্থ-স্বভাবিক জীবনের ব্যবস্থাটুকুও করে উঠতে পারেননি। এই যখন পরিস্থিতি, এনআরসি-আতঙ্ক ছড়ানোর কি খুব দরকার? বাংলা যেমন আছে, তেমনই থাকতে দিন। নইলে পরে যে ক্ষতি হবে, তাতে কপাল চাপড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না কোনো।

একবার ভিটে হারিয়েছেন যে ব্যক্তি, শেষ বয়সে আবার বাস্তুহারা হওয়ার আশঙ্কা তাঁকে কতটা পীড়িত করতে পারে, ভেবে দেখবেন, হে মহান এনআরসি-সমর্থক!

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)