পাঁচ দিন পরে প্রকাশ্যে এসেছিল নেতাজির মৃত্যুসংবাদ – কেন?

প্রথম পর্ব

He was seriously injured when his plane crashed at Taihoku air field at 2 P. M. on August 18. He was given treatment in hospital in Japan where he died at midnight.

২৩ আগস্ট। জাপানের দোমেই নিউজ এজেন্সি থেকে প্রচারিত একটি খবরে চমকে উঠল গোটা বিশ্ব। আজাদ হিন্দ ফৌজের সর্বাধিনায়ক, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু নাকি মারা গিয়েছেন একটি বিমান দুর্ঘটনায়। তাও পাঁচ দিন আগে, ১৮ আগস্ট গভীর রাত্রে। দোমেই নিউজ এজেন্সির পাশাপাশি, একই দিনে, টোকিও রেডিও এবং লন্ডনের রয়টার্সও প্রচার করল খবরটি।

পরেরদিন অর্থাৎ ২৪ আগস্ট আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হল –

গত ২৩শে আগস্ট বৃহস্পতিবার রয়টার লন্ডন হইতে সংবাদ দেন – জাপানী সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠান অদ্য সুভাষচন্দ্র বসুর মৃত্যু-সংবাদ ঘোষণা করিয়াছেন। সঙ্গে সঙ্গে বলা হয় – গত ১৬ই আগস্ট সুভাষচন্দ্র বিমানে সিঙ্গাপুর হইতে টোকিও যাত্রা করেন এবং ১৮ তারিখে তাইহোকু বিমান ক্ষেত্রে তিনি যে বিমানে আরোহী ছিলেন, তাহা দুর্ঘটনায় ভগ্ন হয়। তাঁহাকে হাসপাতালে চিকিৎসা করা হয় – নিশীথে তাঁহার জীবনান্ত ঘটে। সঙ্গী লেফটেন্যান্ট জেনারেল সুনামাশ সিদী ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুমুখে পতিত হন এবং কর্ণেল হাবিবুর রহমান ও ৪ জন জাপানী আহত হয়।

এ তো গেল সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর। কিন্তু গত সাত দশক ধরে বাঙালি যে প্রশ্ন তুলে এনেছে বারবার, তা হল – আদৌ কি বিমান দুর্ঘটনায় মারা গিয়েছিলেন নেতাজি? না পুরোটাই একটা সাজানো ঘটনা?

এ-বিষয়টি এতই বিতর্কিত ও বহুল চর্চিত যে, অসংখ্য বই প্রকাশিত হয়েছে এর ওপর। কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত্বাবধানে প্রকৃত তথ্য জানার জন্য বসেছে তিনটি কমিশনও – শাহানওয়াজ কমিশন১৯৫৬), খোসলা কমিশন(১৯৭০) ও মুখার্জি কমিশন(১৯৯৯)। প্রথম দুটি কমিশনের রায় ছিল, বিমান দুর্ঘটনাতেই মারা গেছেন নেতাজি। মুখার্জি কমিশনের মত, রাশিয়ায় পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি এবং সেখানেই মৃত্যু হয় তাঁর। কেন্দ্রীয় সরকার খারিজ করে দেয় মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট।

যে ডেথ সার্টিফিকেটটি দেওয়া হয় মৃত্যুর পর, তাতে সুভাষচন্দ্র বসু নয়, নাম ছিল ‘ইচিরো ওকুরা’ নামক একজন জাপানি সৈনিকের।

সুভাষচন্দ্রের অন্তর্ধান নিয়ে আগ্রহী বাঙালির কাছে এসব কথা চর্বিতচর্বণ মাত্র। তবু, আমরা যদি তথাকথিত বিমান দুর্ঘটনার দিনে ফিরে যাই, দেখব তথ্য ও জবানবন্দির মধ্যে অসংলগ্নতা ছেয়ে আছে। বিমান দুর্ঘটনার সময়ের বর্ণনা, পতনের বর্ণনা, আহতদের বর্ণনা – একজনের সঙ্গে অপরজনের ফারাক প্রচুর। তবে সাধারণত যেটা প্রচলিত, তা বলছে – দুপুর দুটো আটত্রিশ মিনিটে বিমান দুর্ঘটনাটি ঘটে।

নেতাজির একমাত্র ভারতীয় সঙ্গী, কর্নেল হাবিবুর রহমান জানান, নেতাজির জামাকাপড়ে আগুন লেগে গিয়েছিল। খানিক পরে নেতাজিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাইপে-র নান্‌মন হাসপাতালে। সেখানকার ডাক্তার ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানে আবার হাজার বিভ্রান্তি দেখা যাবে। মোদ্দা কথা, রাত আটটা থেকে মাঝরাতের মধ্যে কোনো এক সময়ে মৃত্যু হয় নেতাজির।

তাঁর ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে বিতর্ক আজও অব্যাহত। যে ডেথ সার্টিফিকেটটি দেওয়া হয় মৃত্যুর পর, তাতে সুভাষচন্দ্র বসু নয়, নাম ছিল ‘ইচিরো ওকুরা’ নামক একজন জাপানি সৈনিকের। সেখানে মৃত্যুর কারণ লেখা আছে ‘হার্ট ফেইলিওর’। কেন নেতাজির নামে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হল না? সাক্ষীরা জানিয়েছেন, সে-সময় সুভাষচন্দ্র বসুর পরিচয় গোপন রাখার জন্যই অন্য একজনের নাম ব্যবহার করা হয়েছিল। গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে, এই যুক্তি মেনে নেওয়া মুশকিল।

আশ্চর্য কী জানেন? চিতাভস্মের ডিএনএ রিপোর্ট করানো হয়েছিল একবার। তা থেকে জানা যায়, চিতাভস্মটি কোনো মানুষেরই নয়। সম্ভবত কোনো পশুর।

নেতাজির মৃতদেহের ছবি বলতে যা দেখানো হয়, তা হল সাদা কাপড়ে মোড়া একটি শব। যে-কারোর হতে পারে। মুখের ছবি তুলে রাখলে এত বিতর্ক উঠতই না। কিন্তু তা তোলা হয়নি কেন? হাবিবুরের বক্তব্য, সুভাষের মুখ ঝলসে গিয়েছিল বলে অমন করুণ পরিণতি তিনি লেন্সবন্দি করতে দেননি। খেয়াল করুন, কীভাবে চালাকি করে এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে সমস্ত প্রমাণের হাত থেকে।

সুভাষচন্দ্র বসু তখন আজান্দ হিন্দ সরকারের সর্বাধিনায়ক। তাঁর দাহকার্য কেন তাইহোকুর ছোট ক্রিমেটোরিয়ামে হল? কেন টোকিও-তে নিয়ে যাওয়া হল না তাঁকে? সে-সময়ে উপস্থিত লোকেদের যুক্তি শুনবেন? তাঁদের কথায়, নেতাজির মরদেহ যে শবাধারে রাখা হয়েছিল, তা আকারে ছিল বড়। আর টোকিও থেকে যে বিমান পাঠানো হয়েছিল নিয়ে যাওয়ার জন্য, তার দরজার আকৃতি ছিল ছোট। ফলে সেই শবাধারটি বিমানে ঢোকানো সম্ভব ছিল না। বাধ্য হয়েই নাকি দাহকার্য সম্পন্ন করতে হয় তাইহোকুতেই।

পরবর্তীকালে নেতাজির তথাকথিত চিতাভস্ম রেখে আসা হয় জাপানের রেনকোজি মন্দিরে। আজও রেনকোজি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সেটির তত্ত্বাবধানে। ভারত সরকার ও নেতাজির পরিবারের অনেকেই মেনে নিয়েছেন, ওই চিতাভস্ম নেতাজিরই। অথচ আশ্চর্য কী জানেন? চিতাভস্মের ডিএনএ রিপোর্ট করানো হয়েছিল একবার। তা থেকে জানা যায়, চিতাভস্মটি কোনো মানুষেরই নয়। সম্ভবত কোনো পশুর।

যাইহোক, প্রথম প্যারায় যে-প্রসঙ্গের উল্লেখ করেছিলাম, সেখানে ফিরি। পাঁচ দিন পরে মৃত্যুর খবর প্রকাশ্যে আনা হল কেন? বিভিন্নজন বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তবে গবেষকরা প্রায় সকলেই একমত, সুভাষের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে গেলে পুলিশ তৎপর হয়ে উঠত, অনুসন্ধান শুরু করে দিত। কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রশক্তির কাছে সুভাষ একজন যুদ্ধাপরাধী। ফলে, তাঁকে নিরাপদে পালিয়ে যেতে দেওয়ার জন্যই ওই পাঁচদিন সময় নেওয়া হয়েছিল। তাইহোকুর সাজানো বিমান দুর্ঘটনার(সাজানো? কোনো কোনো রিপোর্ট আবার বলছে, সুভাষ থাকুন বা না থাকুন, সত্যিই বিমান দুর্ঘটনা হয়েছিল সেদিন) চিত্রনাট্য বানিয়ে সুভাষ পালিয়ে গিয়েছিলেন নিরাপদ স্থানে। সেখানে তিনি পৌঁছনোর পর, জাপান সরকার প্রচারিত করে মৃত্যুসংবাদ। মোদ্দা কথা, সুভাষের এই অন্তর্ধানে সাহায্য করেছিলেন জাপান সরকারের অফিসাররা, কর্নেল হাবিবুর রহমানও। কিন্তু এ-বিষয়ে মুখ খোলেননি কেউই।

কিন্তু পালিয়ে কোথায় গেলেন সুভাষ? এ-নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। সুভাষ-রহস্যে, বিমান দুর্ঘটনার পরেই সর্বাধিক আলোচিত বিষয় এটি। বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, রাশিয়ায় চলে গিয়েছিলেন তিনি। তারপর?

(ক্রমশ)

ছবি ঋণ -
ইন্টারনেট
সুভাষ ঘরে ফেরে নাই(শৈলেশ দে)