কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ল কুষ্ঠ; আক্রান্ত ৩০ হাজার; এগিয়ে এলেন মাদার টেরেসা

স্বাধীনতার পর কেটে গেছে বেশ কিছু বছর। কিন্তু দেশবাসীর অবস্থা ঠিক কেমন? দেশভাগের ধাক্কায় ভিটেছাড়া হয়েছে কয়েক লক্ষ মানুষ। রাস্তায়, স্টেশনে পড়ে অনেকেই। বাংলার অবস্থা একসময় ভয়াবহ পর্যায়ে চলে গেল। একে উদ্বাস্তুদের ভিড়, তার ওপর কয়েক বছর আগেই ঘটে গেছে দুর্ভিক্ষ। অনেকের পেটে দেওয়ার মতো খাবার নেই। অপরিচ্ছন্ন অবস্থা। তাও বেঁচে থাকার চেষ্টা করছিল আপামর বঙ্গবাসী। এমন সময় হানা দিল আরও একটি রোগ— কুষ্ঠ। কলকাতা এবং তার আশেপাশের অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ল রোগটি। যন্ত্রণাদায়ক; তার ওপর ছোঁয়াচে! চিকিৎসা কী করে হবে! এদিকে যে রোগ বেড়ে যাচ্ছে…

আরও পড়ুন
মহামারীতে ছারখার বাংলা, মৃত ৫০ হাজারেরও বেশি, বাদ গেল না সাহেবরাও

যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সেটা পঞ্চাশের দশক। কুষ্ঠ রোগীদের ঢল নামল তিলোত্তমায়। সেই সময়ের একটি হিসেব অনুযায়ী, কলকাতা ও তাঁর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রায় ৩০ হাজার কুষ্ঠ রোগী ছিলেন। এমন পরিস্থিতি, যখন প্রায় কেউই এগিয়ে আসছেন না, তখন এগিয়ে এল একটি হাত। ওই ঘিঞ্জি পরিবেশের মধ্যে বসে রোগীরা দেখল, এক বিদেশিনী তাদের সুস্থ করার জন্য এগিয়ে আসছেন। সাদা শাড়ি, নীল পাড়— দেবদূতের থেকে কম মনে হচ্ছিল কি অ্যাগনেসকে? অবশ্য এই নামটি কলকাতা শোনেনি তখন। ওই বিদেশিনী অন্য একটি নামে বরং পরিচিত শহরে। শুধু শহর কেন, গোটা বিশ্ব তাঁকে ওই নামেই একদিন চিনবে, সন্ত ঘোষণা করবে। সিস্টার টেরেজা, কালে কালে যিনি হয়ে উঠেছিলেন সকলের ‘মাদার’!

আরও পড়ুন
তাঁর সামনে থমকেছে মহামারীও, মৃত্যুহার ৪০ শতাংশ কমালেন ফ্লোরেন্স নাইটেঙ্গেল

আপাতত ধর্মীয় প্রসঙ্গ বাদ থাক। পঞ্চাশের দশকে যখন কুষ্ঠ মোকাবিলায় আসতে বাধছিল সবার, তখন অবলীলায় সেই দায়িত্ব তুলে নিলেন মাদার টেরেজা। অবশ্য ডাক্তারদের কি দোষ দেওয়া যায়? কুষ্ঠ রোগটি মহামারীর আকার নেয়নি ঠিকই; কিন্তু একটা বড়ো অংশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল দ্রুত। মহামারীর আগেই যাতে একে থামানো যায়, সেটার বন্দোবস্ত করতে হত। কিন্তু রোগটি যে প্রবল ছোঁয়াচে! সারানো যে যায় না তা নয় একেবারেই। কিন্তু আগে তো অকুস্থলে পৌঁছতে হবে, তারপর তো চিকিৎসা! আর জায়গাগুলিও নোংরা, অস্বাস্থ্যকর। খাবার দাবারেরও ছিরিছাঁদ নেই। এমন অবস্থায় তো রোগ ঘিরে ধরবেই! প্রশাসন থেকে আরম্ভ করে সবাই চেষ্টা করছেন, কিন্তু যথেষ্ট হচ্ছে না…

আরও পড়ুন
‘দরকার হলে বেলুড় মঠের জমি বিক্রি করে দেব’, মহামারী রুখতে সংকল্প বিবেকানন্দের

এমন অবস্থায়, ১৯৫২ সালের ২২ আগস্ট কলকাতায় একটি নতুন প্রতিষ্ঠান জন্ম নিল। ‘নির্মল হৃদয়’। সমস্ত মরণাপন্ন কুষ্ঠরোগীদের এখানে নিয়ে এলেন মাদার টেরেজা। ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, সবার আগে এদের ওই পরিবেশ থেকে বের করতে হবে। ঠিকঠাক যত্ন, পরিচ্ছন্নতা, খাবার, ওষুধ দিলে এরা ঠিক হবে, হবেই। রাস্তায় রাস্তায় পড়ে থাকা রোগীদের নির্মল হৃদয়ের ঘরে নিয়ে আসা হল। সেখানে পরিষ্কার করে, স্নান করিয়ে তাদের জায়গা দেওয়া হল। সেইসঙ্গে শিশুদের দেখভালের জন্যও আলাদা সংগঠন খোলা হল। কুষ্ঠরোগীদেরও সমাজ থেকে একপ্রকার একঘরে করে রাখা হত। সেইসঙ্গে ছিল ধর্মীয় সংস্কার। সব বাধা কাটিয়ে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে লাগলেন মাদার টেরেজা।

আরও পড়ুন
মহামারী রুখতে পথে রবীন্দ্রনাথ, ঘরছাড়া জগদীশচন্দ্র; মারা গেল অবনীন্দ্রনাথের ছোট্ট মেয়ে

১৯৫৬ সালে আসানসোলের কাছে একটি নতুন সেন্টার খুলল মিশনারিজ অফ চ্যারিটি। নাম ‘শান্তিনগর’। শুধু কুষ্ঠরোগীদের জন্যই খোলা হল এমন সেন্টার। প্রথমে মাত্র পাঁচজন রোগী এলেও হাল ছাড়েননি টেরেজা। ততদিনে তিনি মাদ্রাজের এক ডাক্তারের পদ্ধতি লক্ষ্য করেছেন নিবিড়ভাবে। ডাঃ ফ্রাঞ্জ হেমেরিজিক্স বলে সেই ডাক্তার মাদ্রাজে কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসায় সফল হয়েছিলেন সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায়। সেই একই জিনিস বাংলাতেও শুরু করলেন টেরেজা। সমস্ত জায়গায় মিশনারিজ অফ চ্যারিটির মোবাইল ক্লিনিক পৌঁছতে লাগল। একজন কুষ্ঠরোগীও যাতে অসুবিধায় না পড়ে, সেটা যেন নিশ্চিত হয়। যারা অসুস্থ, তাদের বাড়ি বাড়ি বিনামূল্যে পৌঁছে দেওয়া হল চাল আর দুধ। ভালোভাবে যাতে খেয়ে পরে থাকে, পরিচ্ছন্ন থাকে সেটাই খেয়াল রাখা হল।

আরও পড়ুন
করোনাই শেষ নয়, আরও ভয়ংকর মহামারী আসতে চলেছে, আশঙ্কা পরিবেশবিদদের

এই সবকিছুর ফল পাওয়া গেল শীঘ্রই। আস্তে আস্তে সুস্থও হতে শুরু করেছিলেন অনেকে। এই সময়ই লেপ্রসি বা কুষ্ঠ নিয়ে সচেতনতা বাড়াতে উদ্যোগ নিলেন মাদার টেরেজা। শুরু করলেন বিশেষ একটি দিন ‘লেপ্রসি ডে’। তৈরি করলেন বিশেষ ফান্ড। সংবাদমাধ্যমকে জানিয়ে একটি উদ্যোগ নেওয়া হল, ‘লেপ্রসি কালেকশন ডে’। অন্যান্য সিস্টারদের সঙ্গে স্বয়ং মাদারও রাস্তায় বেরিয়ে পড়লেন। সেখান থেকে যা অর্থ সংগ্রহ হল, সমস্তটা ব্যয় করা হল কুষ্ঠ চিকিৎসায়। সরকারও একটি বিশাল এলাকা কুষ্ঠরোগীদের সেবার জন্য দিয়ে দিল। তৈরি হল বসবাসের জায়গা। আজ যা পরিচিত ‘টিটাগড়’ নামে।

আরও পড়ুন
মহামারীর জন্য ‘ওয়ার্ক ফ্রম হোম’, ঘরে বসেই মাধ্যাকর্ষণ সূত্র আবিষ্কার নিউটনের

কুষ্ঠরোগীকে বাঁচানো সম্ভব, এই রোগকেও রোখা সম্ভব। যদি একটু যত্ন নেওয়া যায়, রোগীর প্রতি একটু খেয়াল রাখা যায় তাহলেই এটি সম্ভব। ক্ষতস্থানগুলি ভালোভাবে ঢেকে রেখে চিকিৎসা করলে কোনো সমস্যাই নয়। সবার আগে প্রয়োজন আশেপাশের সমস্তটা পরিষ্কার রাখা, আর সুষম খাবার খাওয়া। মাদার টেরেজা এই দিকগুলোর দিকেই নজর দিয়েছিলেন। নিজের দিকেও একইরকমভাবে খেয়াল রাখতেন। তাই এত বিপুল কুষ্ঠরোগীর সংস্পর্শে এসেও তিনি অসুস্থ হননি। এই পথই সবাইকে দেখিয়েছেন। রোগ মোকাবিলা খুব সহজেই করা যায়; শুধু দরকার সচেতনতা। প্রশাসনের তো বটেই, তারও আগে দরকার আমার আপনার মতো সাধারণ মানুষের। ওই সময় মাদারের এই শিক্ষা কি আজও মেনে চলতে পারি না আমরা? নিশ্চয়ই পারি, আমরা করব জয়; নিশ্চয়!

Powered by Froala Editor

More From Author See More