বলিউডের ড্রাগচক্র ও একটি ‘একুশে আইন’-এর দেশ

শনিবার সারাদিন ধরে মুম্বই শহরে ঘটে গেল এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা। দীপিকা পাডুকোন, সারা আলি খান এবং শ্রদ্ধা কাপুরকে জেরা করল নার্কোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো বা এনসিবি। জিজ্ঞাসাবাদ করা হল দীপিকার ম্যানেজারকেও। গতকাল সারা দেশের কৃষকরা যেভাবে কৃষি বিলের বিরুদ্ধে পথে নেমেছিল, তার ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবনাচিন্তার অবকাশ হারিয়ে গেল হঠাৎ। তার থেকে অনেক বেশি টিআরপি আনতে পারে এই জিজ্ঞাসাবাদ। দেশের অর্থনীতির থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, বলিউডের অভিনেত্রীরা মাদকাসক্ত কিনা।

এখানে ‘অভিনেত্রী’ কথাটা খেয়াল করুন। এখনও অবধি দীপিকা পাড়ুকোন, সারা আলি খান, শ্রদ্ধা কাপুর, রাকুলপ্রীত সিং ও সিমোন খামবাট্টার কাছে শমন পাঠিয়েছে এনসিবি। আর অদ্ভুতভাবে প্রত্যেকেই অভিনেত্রী, অর্থাৎ মহিলা। তাহলে কি বলিউডের অভিনেতারা কেউই মাদকাসক্ত নন? নাকি মহিলা হয়েও ড্রাগ সেবন করেন এঁরা, সেটাই সবচেয়ে বড়ো অপরাধ?

এই প্রশ্নকেই আরও জোরদার করে তোলে প্রথম সারির মিডিয়াগুলির একধরনের বিকৃত রুচির সংবাদ প্রদর্শন। ড্রাগচক্র নিয়ে আলোচনার মাঝে মাঝে বারবার প্রকাশ করা হচ্ছে অভিনেত্রীদের বিকিনি বা ছোটো পোশাক পরা ছবি। অর্থাৎ যেন ছোটো পোশাক পরার সঙ্গে ড্রাগ সেবনের কোনো সম্পর্ক আছে। নাকি সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমে থাকা নারীবিদ্বেষী মানসিকতাই প্রকাশ পাচ্ছে একভাবে? আবার যেভাবে ‘ড্রাগচক্র’ শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে, তাও অবাক করে। এখনও অবধি প্রত্যেক অভিনেত্রীর বিরুদ্ধেই ব্যক্তিগতভাবে ড্রাগ সেবনের অভিযোগ আনা হয়েছে। কোনোভাবে ড্রাগ ব্যবসার সঙ্গে তাঁরা জড়িত বলে তথ্য পাওয়া যায়নি। তাহলে ‘ড্রাগচক্র’ শব্দটি ব্যবহার করা কি আদৌ যুক্তিযুক্ত?

হ্যাঁ, বিগত বেশ কিছু দশক ধরেই ভারতে ড্রাগের ব্যবসার রমরমা চোখে পড়ার মতো। শুধু ভারতেই নয়, সারা পৃথিবীতেই আর্থিক অচলাবস্থার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে মানুষের মধ্যে হতাশা। আর এর ফলেই নেশার মধ্যে মুক্তির উপায় খুঁজছেন অনেকে। বিশেষ করে উচ্চবিত্তদের মধ্যেই এই সমস্যা প্রবল। সেখানে বলিউডের একাধিক অভিনেতা-অভিনেত্রী ড্রাগ সেবনে অভ্যস্ত হবেন সেটাই স্বাভাবিক। গ্ল্যামার ওয়ার্ল্ডের যেকোনো ক্ষেত্রেই ছবিটা মোটামুটি একইরকম। করণ জোহরের পোস্ট করা হাউস-পার্টির ভিডিওতেই রণবীর কাপুর, বরুণ ধাওয়ান, ভিকি কৌশল, শাহিদ কাপুর, অর্জুন কাপুরদের মতো অভিনেতাদের দেখে কি মনে হয়, তাঁরা খুব স্বাভাবিক অবস্থায় ছিলেন? তাহলে সব ছেড়ে কেন শুধু অভিনেত্রীদেরই টার্গেট করা হচ্ছে?

আর এসবের মধ্যে ড্রাগ ব্যবসার চক্র নিয়ে কি আদৌ চিন্তিত এনসিবি? যেভাবে অসংখ্য মারণ ড্রাগ দেশে ছড়িয়ে পড়ছে আর তাতে আশক্ত হয়ে পড়ছেন অসংখ্য পড়ুয়া এবং কিশোর-কিশোরী, তাকে আটকানোর উপায় কী? বরং যেখানে মাদকাসক্ত মানুষদের মানসিক চিকিৎসার প্রয়োজন, সেখানে এধরনের পুলিশি জেরা কি আরও বেশি করে অবসাদের দিকে ঠেলে দেবে না? আর এই ‘অতি প্রয়োজনীয়’ বিষয়ে যেভাবে সমস্ত প্রশাসনিক শক্তি নিয়োগ করে দেওয়া হচ্ছে তাতে প্রশ্ন ওঠে দেশের অন্যান্য সমস্যা কি মিটে গিয়েছে? ক্রমবর্ধমান করোনা সংক্রমণ রুখতে ব্যর্থ প্রশাসন। চিকিৎসকরা উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব বুঝতে পারছেন। ঐতিহাসিক পতন হয়েছে জিডিপি-র। তার মধ্যে কৃষি বিল নিয়ে নতুন করে শুরু হয়েছে জটিলতা। কর্মহীন দেশের এক বিরাট অংশের যুবশক্তি। কিন্তু এসবের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ‘অভিনেত্রী’-দের মধ্যে কে কে মাদকাসক্ত, তার হদিশ খুঁজে বের করা। সাম্প্রতিক এইসব ঘটনার ঘনঘটা যেন বারবার ‘একুশে আইন’-এর দেশের কথাই মনে করিয়ে দেয়।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

আরও পড়ুন
ডিজিটাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রণের আর্জি কেন্দ্রের, অপপ্রচার আটকানোর আড়ালে কি বিরোধীদের কণ্ঠরোধ?

Powered by Froala Editor

More From Author See More