ক্যানসার-আক্রান্ত সতীর্থের পাশে বাংলার ম্যাজিশিয়ানরা, জাদুতে আচ্ছন্ন কলকাতা

মঞ্চে দাঁড়িয়ে জোব্বা পরা এক ব্যক্তি। কখনও তাঁর টুপির আড়ালে হারিয়ে যাচ্ছে একঝাঁক পায়রা। কখনও হাতে ধরা নানা রঙের কাপড়ের টুকরো মিলে গিয়ে হয়ে উঠছে একটিমাত্র রুমাল। হ্যাঁ, ম্যাজিকের কথাই হচ্ছে। ছোটো থেকেই যে সমস্ত অদ্ভুত খেলা আমাদের মুগ্ধ করে, আচ্ছন্নও করে রাখে। তবে মঞ্চের এই ম্যাজিকের চেয়েও বোধহয় অনেক বড়ো ম্যাজিক মানুষের বেঁচে থাকা। আরও ভালোভাবে বলতে গেলে, একটি সমাজে বহু মানুষের একসঙ্গে বেঁচে থাকা। গতকাল শিশির মঞ্চে ফোরাম অফ ইন্ডিয়ান ম্যাজিক অ্যাসোসিয়েটস (ফিমা) কর্তৃক আয়োজিত জাদু প্রদর্শনীতে গিয়ে অন্তত সেই কথাই মনে হচ্ছিল।

ম্যাজিকের প্রদর্শনীতে নানা বয়সের নানা মানুষের ভিড় হবেই। বিশেষ করে একই মঞ্চে যদি উপস্থিত থাকেন বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী জাদুকরেরা – তাহলে তো কথাই নেই। আর ফিমা আয়োজিত ‘ম্যাজিকেয়ার ২০২২’-এ ম্যাজিকের সঙ্গেই ছিল স্যান্ড আর্ট এবং হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফির প্রদর্শনীও। তবে এই সমস্ত শিল্পীরা এক মঞ্চে মিলিত হয়েছিলেন একটি অন্য তাগিদ থেকে। বিগত কয়েকমাস ধরেই গুরুতর অসুস্থ ফিমার অন্যতম সদস্য, হাওড়া ম্যাজিক সার্কেলের প্রেসিডেন্ট ম্যাজিশিয়ান বিশ্বজিত। তাঁর শরীরে ক্যানসার ধরা পড়েছে। চিকিৎসকরা অবশ্য আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু চিকিৎসার জন্য বেশ কিছু অর্থের প্রয়োজন। আর সেই অর্থ জোগাড় করতেই শিশির মঞ্চে এই অভিনব প্রদর্শনীর পরিকল্পনা নিয়েছিলেন ফিমার সদস্যরা।

সহশিল্পীদের এই আয়োজনে দূরে সরে থাকতে পারেননি আরেকজন জাদুকর। বস্তুত বাঙালির কাছে ম্যাজিক বললেই যাঁর নাম মনে আসে, সেই পিসি সরকার জুনিয়র। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ছুটে এসেছেন শিশির মঞ্চে। নিজে অবশ্য খেলা দেখাতে পারেননি। কিন্তু সহশিল্পীদের মনে সাহস জুগিয়েছেন। তাঁদের উদ্দেশ্য সফল হওয়ার শুভকামনাও জানিয়েছেন। ম্যাজিকের আয়োজন শুরুই হল এমন এক অপ্রত্যাশিত ম্যাজিক দিয়ে।

‘ম্যাজিকেয়ার ২০২২’-এ ম্যাজিকের আয়োজন তো ছিলই। সেইসঙ্গে বিশেষ আকর্ষণ হিসাবে ছিল স্যান্ড কৌশিকের স্যান্ড আর্টের প্রদর্শনী। বালির রেখায় একের পর এক ছবি সৃষ্টি করেই মুছে ফেলার এই ক্ষণজীবি শিল্প সত্যিই এক আলাদা মুগ্ধতা এনে দেয়। স্যান্ড কৌশিকের প্রদর্শনীর কথা অবশ্য আগে থেকেই ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু মঞ্চে নিজে প্রদর্শনী শুরু করার আগে তিনি ডেকে নিয়েছিলেন জাদুকর অমর সেনকে। ভারতে স্যান্ড আর্ট নামক শিল্পটির পথিকৃত যে তিনিই। এছাড়াও খুব সামান্য সময়ের পরিসরে হলেও অমর সেন দেখালেন তাঁর আরেক অবাক করা শিল্প। হ্যান্ড শ্যাডোগ্রাফি। টর্চের আলোর সামনে হাতের ছায়ায় মঞ্চের পিছনের পর্দায় ফুটে উঠল মানুষের মুখের জটিল ছায়াচিত্র। সেই ছায়াচিত্র কথাও বলল। এছাড়া পাশ্চাত্যের যান্ত্রিক জাদুবিদ্যা নিয়ে হাজির হয়েছিলেন ম্যাজিশিয়ান শুভ্রাংশু। হোয়াইট বোর্ডের উপর আঁকা ছবি নিয়ে অনবদ্য ভেন্ট্রিলোকুইজম দেখালেন ম্যাজিসশিয়ান রজত ভেঙ্কটেশ নরসিংহম। হোয়াইট বোর্ডে আঁকা সেই ছবিটি গান গেয়ে ম্যাজিসিয়ান বিশ্বজিতের দ্রুত আরোগ্যের বার্তাও ছড়িয়ে দিল। মেন্টালিজমের খেলা দেখালেন তরুণ জাদুকর শতাব্দ। আর সবশেষে মাদারির খেলা দেখিয়ে মুগ্ধ করলেন ম্যাজিসিয়ান এ সরকার। প্রথমে তিনটি এবং শেষে একটিমাত্র তীক্ষ্ণ তরোয়ালের ফলায় ভাসিয়ে রাখলেন এক সম্মোহিত বালিকাকে।

প্রায় আড়াই ঘণ্টার এই অনুষ্ঠানে দর্শকরা তো মুগ্ধ হলেনই। খুশি হয়েছেন আয়োজকরাও। তাঁদের উদ্দেশ্যও যে অনেকখানি সফল। সহশিল্পীদের পরিশ্রমে এবং ম্যাজিকপ্রিয় দর্শকদের ভালোবাসা ও শুভকামনাও আবারও কিছুদিনের মধ্যেই মঞ্চে হাজির হবেন ম্যাজিশিয়ান বিশ্বজিত। এই প্রত্যাশা নিয়েই শেষ হল ‘ম্যাজিকেয়ার ২০২২’। মঞ্চের এই ম্যাজিক শেষ হল। কিন্তু বিশ্বজিত ও তাঁর সহশিল্পীদের এই বেঁচে থাকার লড়াই, তা যে শেষ হওয়ার নয়। বিগত লকডাউন শিল্পীদের অবস্থা সঙ্গীন করে তুলেছিল। আর তারই দোসর হয়ে এসেছে আরেকটি ঝড়। তবে সব ঝড়ই একদিন থেমে যায়। নাহলে ম্যাজিক হবে কী করে?

Powered by Froala Editor

More From Author See More