নাৎজি সৈনিক ও ইহুদি বন্দিনীর প্রেম, যে অপূর্ণ সম্পর্কের সাক্ষী ছিল কনসেনট্রেশন ক্যাম্প

গত শতাব্দীর চল্লিশের দশক সাক্ষী ছিল কিছু নারকীয় শব্দের। গ্যাস চেম্বার, কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প, জেনোসাইড, মৃত্যু। হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষের জীবন এক লহমায় শেষ হয়ে গিয়েছিল স্রেফ ‘ইহুদি’ হওয়ার অপরাধে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও হিটলার কত কালো ছাপ রেখে গেছে ইতিহাসে এভাবে। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রেও কি কখনও ফোটে না গোলাপ? ঘৃণা ও অন্ধকারের মাঝে কি ফিরে ফিরে আসে না প্রেম? হেলেনা সিট্রোনোভা ও ফ্রানৎজ উন্সের গল্প তাহলে কীসের?

১৯৪২। বসন্তের ছোঁয়া এসে পড়েছে প্রকৃতির বুকে। সেই মুগ্ধতার মধ্যে দিয়ে চলেছে দুটি ট্রেন। তার ভেতর সওয়ার প্রায় দুই হাজার জন অবিবাহিত মহিলা। না, তাঁদের মনে বসন্ত আসেনি। বরং জমা হয়েছে শঙ্কার কালো মেঘ। স্লোভাকিয়া থেকে এই দুটি ট্রেন চলেছে আউশভিৎজের দিকে। সেই কুখ্যাত আউশভিৎজ! নাৎজি বাহিনীর কুখ্যাত কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলির অন্যতম। মৃত্যু ক্রমশ নিঃশ্বাস ফেলছে ওই দুই হাজার নারীর ওপর। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন হেলেনা সিট্রোনোভা। বারবার ফিরে যেতে চাইছেন জীবনের কাছে, কিন্তু তার কি আর উপায় আছে…

আরও পড়ুন
অভাবী পড়ুয়াদের জন্য হাজির ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরি, বাঙালি দম্পতির উদ্যোগ

একদিন লাঞ্চের পর একজন নাৎজি পুলিশ হাজির হলেন মেয়েদের সামনে। ‘কেউ কি গান গাইতে পারে এখানে? জন্মদিনের গান?’ জীবনের এ কি রকম পরিহাস! গ্যাস চেম্বারের ডোম বন্ধ করা মৃত্যু যাঁদের পরিণতি, তাদের কাছ থেকে জন্মদিনের গান? হয়ত এমনটা ভেবেছিলেন হেলেনাও। কিন্তু এগিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। শেষের আগে, একবার অন্তত জীবনের গানটি গেয়ে যাওয়া যাক!

জন্মদিনটি ছিল ফ্রানৎজ উন্সের। অস্ট্রিয়ান এই যুবক ছিলেন হিটলারের নাৎজি বাহিনীর একজন ল্যান্স কর্পোরাল। হেলেনা গাইলেন জন্মদিনের গান। সমস্ত দুঃখ, জীবনের আবেগ যেন ঝরে পড়ল তাঁর গলায়। কেঁদেও ফেললেন শেষে। ফ্রানৎজ অবাক হয়ে গেলেন। এর আগেও হয়তো দেখেছিলেন এই ইহুদি বন্দিনীকে; আজ যেন একটু বেশি মনোযোগ দিয়ে দেখলেন। বারুদের ওপর গোলাপ ফোঁটার সেই শুরু। না, সেই বীভৎস ঘরে পরে যেতে হয়নি হেলেনার। ফ্রানৎজের বন্দোবস্তে তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন সে যাত্রা।

আরও পড়ুন
নিরক্ষর ক্রীতদাস তিনি, অঙ্কের জাদুতে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন সবাইকে

তিনি বিলক্ষণ জানতেন, একজন ইহুদি বন্দিনীকে বাঁচানোর শাস্তি কী হতে পারে। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, ততই বেড়েছে প্রেম। ফ্রানৎজ যে ভালবেসে ফেলেছেন হেলেনা-কে! হোক শাস্তি, তাও ওকে বাঁচাবেন তিনি। মুক্ত করবেন এই পরিবেশ থেকে। পরে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে হেলেনা বলেছিলেন, একবার নয়, একাধিকবার নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছিলেন ফ্রানৎজ। গ্যাস চেম্বার থেকে রক্ষা করেন তাঁর বোনকেও। হেলেনাও যে ততদিনে তাঁকে মন দিয়ে দিয়েছেন…

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক সময় ছিটকে দিয়েছিল দুজনকে। কোনো যোগাযোগ ছিল না। সব শান্ত হয়ে যাওয়ার পর হেলেনা’কে পাগলের মতো খোঁজেন ফ্রানৎজ উন্স। হয়ত ভেবেছিলেন, স্লোভাকিয়ার সেনারা ওকে ধরে নিয়ে গেছে। না, সেখানেও নেই। আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন একসময়।

আরও পড়ুন
পরিবহনের অভাবে মারা গিয়েছিলেন মা, গ্রামবাসীদের জন্য ‘বাইক-অ্যাম্বুলেন্স’ রাজডাঙার করিমুলের

তারপর এল ১৯৭২। দীর্ঘ তদন্তের পর অস্ট্রিয়াতেই গ্রেফতার করা হয় ফ্রানৎজ উন্সকে, প্রাক্তন নাৎজি অফিসার হিসেবে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে তাঁর ট্রায়াল শুরু হয়। এমন সময় আদালতে ছুটে আসেন দুজন মহিলা। বন্দি ফ্রানৎজ অবাক হয়ে দেখেন, আদালতে দাঁড়িয়ে আছে হেলেনা সিট্রোনোভা ও তাঁর সেই বোন, যাকে গ্যাস চেম্বার থেকে উদ্ধার করেছিলেন তিনি। আনন্দে, বিস্ময়ে মন ভরে গেল তাঁর। তাহলে, বেঁচে আছে সে!

মূলত হেলেনা আর তাঁর বোনের সাক্ষ্য প্রমাণেই ছাড়া পান তিনি। পরে নিজের ফেলে আসা জীবনের দিকে তাকিয়ে ফ্রানৎজ জানান, একসময় সত্যিই বড় নিষ্ঠুর ছিলেন তিনি। কিন্তু হেলেনা’র প্রেম, তাঁর সাহচর্য তাঁকে বদলে দিয়েছে পুরোপুরি। অন্য মানুষ করে দিয়েছে। হেলেনাও প্রথম দিকে ঘৃণাই করতেন ফ্রানৎজকে। কিন্তু পরে সমস্তটা বদলে যায়। না, কখনও পূর্ণতা পায়নি এই সম্পর্ক। কিন্তু ভেতরে ভেতরে যোগাযোগ কি থাকেনি তাঁদের?

আরও পড়ুন
বাঘের জন্য জমি কিনে তৈরি করেছেন জঙ্গল, ব্যাতিক্রমী নজির দম্পতির

দুজনের কেউই আজ জীবিত নেই। ২০০৫ সালে হেলেনা সিট্রোনোভা মারা যান। ঠিক চার বছর পর, ২০০৯ সালে ফ্রানৎজ উন্সও। কিন্তু যুদ্ধের কালো ইতিহাসে তাঁদের কাহিনি অমর হয়ে থেকে গেছে। আউশভিৎজের রুক্ষ মাটিতে অন্তত একটি গোলাপ তো ফুটেছিল। ভবিষ্যৎ পৃথিবীর কাছে হিংসা, হানাহানির মধ্যেও এই ছোট্ট আশাটুকু থাকুক। আমরা করব জয়, নিশ্চয়…

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More