মুণ্ড শিকারের গ্রাম! ভারত-মায়ানমার দু’দেশেরই নাগরিক এই গ্রামের বাসিন্দারা

সীমান্ত পাহাড়ে থরেথরে সাজানো কাঁচা বাড়ি। দেবদারু, ফার্ন, ঝাউয়ের বন পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে। জঙ্গলে বনশুয়োর, ভাল্লুকসহ নানান চারপেয়েদেরও বাস। ইতিউতি উঁকি দিচ্ছেন স্থানীয়রা। প্রেমে পড়ার মতো অপরূপ এক প্রত্যন্ত গ্রাম লংওয়া (Longwa/ Lungwa), নাগাল্যান্ডের (Nagaland) মোন (Mon) জেলায়।

গ্রামে রয়েছে ৭০০-র মতো পরিবার। মোট জনসংখ্যা ৬৭০৩। গ্রামটিতে একইসঙ্গে একই সময়ে থাকা যায় ভারত ও মায়ানমার দুই দেশেই। কীভাবে? গ্রামের প্রধানের বাড়িতে উঠলেই এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতার স্বাদ মিলবে। প্রধানকে স্থানীয় ভাষায় বলে ‘অ্যাং’ বা ‘ওঅ্যাং’। তাঁদের কদর পর্বতসমান। প্রচুর সম্মানের অধিকারী। কথিত আছে, একসময় শত্রুর মুণ্ড শিকার করলে তাঁরা মুখের উল্কি আঁকতেন। সেই উল্কি অন্য সাধারণের চেয়ে আলাদা। গ্রামের মাঝখানেই সেই প্রধানের বাড়ি। যার রান্নাঘর ভারতে, শয়নকক্ষ মায়ানমারে। এই প্রধান কিন্তু নাগা পুরাণের কোনো চরিত্র। এখনকার প্রধানের সঙ্গে মিল নেই।

লংওয়া গ্রামবাসীরা একমাত্র জনজাতি, যাঁরা ভারত (India) ও মায়ানমার (Myanmar), দুই দেশেরই নাগরিক। তাঁদের অনেকেই দুই দেশের নির্বাচনেই ভোট দেন। আন্তর্জতিক সীমানা গ্রামের মাঝখান দিয়ে। কোন্যাক (Konyak) জনগোষ্ঠীর বাস লংওয়ায়। গ্রামের মাঝ বরাবর আন্তর্জতিক সীমানা কি স্থানীয়দের জীবনকে প্রভাবিত করেছে? কোন্যাক জনগোষ্ঠীর কাউকে এই প্রশ্ন করুন। তিনি মুখে একচিলতে হাসি নিয়ে বলবেন, গ্রামকে দু’ভাগ করার আগে কেউ তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করেননি। তাই কোন্যাকরাও বাইরের করোর উপদেশ নেন না। তাঁরা নিজেদের মতোই জীবনযাপনে অভ্যস্ত।

নাগাল্যান্ডের মোন জেলা বৈচিত্র্যময়। নিজস্বতায় টইটম্বুর। জেলার লংওয়া গ্রামের আয়তন সবচেয়ে বড়। রয়েছে ২৭টি কোন্যাক গ্রাম। এরমধ্যে লংওয়া প্রধান মোন শহর থেকে ৪২ কিমি দূরে। ভারত-মায়ানমার দুই দেশের প্রায় ৭০টি নাগা গ্রাম শাসন করেন অ্যাং। সীমান্তের ওপারে যাওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের ভিসার প্রয়োজন হয় না। সেখানে তাঁদের অবাধ বিচরণ। গ্রামের কিছু তরুণ মায়ানমার সেনাবাহিনীতে নিয়োগপ্রাপ্ত। লংওয়া অতিথিপরায়ণ নাগাদের সঙ্গে কাটানোর এক শান্তিপূর্ণ এবং নির্মল জায়গা।

আরও পড়ুন
মহারাষ্ট্রের যে গ্রামে বিষধর সাপেরাও মানুষের ‘দোস্ত’

পর্যটকদের কাছেও গ্রামটি উপভোগ্য। তাঁরা তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করেন ডোয়াং নদীর সৌন্দর্য। নদীটি নাগাল্যান্ডের দীর্ঘতম। নদী ছাড়াও নাগাল্যান্ড বিজ্ঞান কেন্দ্র, হংকং মার্কেট, শিলোই লেক প্রাণভরে দেখে নেওয়া যায়। কাছাকাছি আসাম রাইফেলসের ক্যাম্প চোখে পড়বে। গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি পাহাড়ে '154 BP 1971-72' লেখা আন্তর্জাতিক সীমান্ত চিহ্নিত একটি স্তম্ভ রয়েছে।

আরও পড়ুন
শুধুমাত্র দিব্যাঙ্গদের জন্য আস্ত গ্রাম ইংল্যান্ডে

অতীতে, এই জনগোষ্ঠী প্রায়ই মুণ্ড শিকার অভিযানে কাছাকাছি কোনো গ্রামে আক্রমণ শানাত। গোত্রের ক্ষমতা এবং জমির উপর নিয়ন্ত্রণ লাভের জন্য প্রতিবেশী গ্রামের সঙ্গে এই যুদ্ধ। বিরোধী যোদ্ধাদের মাথা কেটে ফেলার জন্য পরিচিত ছিল এই জনগোষ্ঠী। শিরশ্ছেদ করা মাথাগুলি জয়চিহ্নের স্মারক। সাধারণত 'বান'-এ (সম্প্রদায়ের একটি ঘর) ঝুলিয়ে দেওয়া হত সেইসব মাথা। শিকার করা মাথার সংখ্যাই নির্দেশ করত একজন যোদ্ধার শক্তি কতটা। বয়স্ক কোন্যাকরা এখনও পিতলের খুলির নেকলেস পরেন। যা যুদ্ধের সময় শত্রুর খুলি সংগ্রহের প্রমাণ বহন করে। শক্তি, সমৃদ্ধি ও উর্বরতার ইঙ্গিত এই হেডহান্টিং (Headhunting)। আপনি বিশ্বাস করুন বা না করুন, এমনটাই বিশ্বাস কোন্যাকদের। ১৯৪০ সাল থেকে মাথা শিকারের এই ঐতিহ্য সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। তবে, তার পরেও বিক্ষিপ্তভাবে চলত মুণ্ড শিকারের অভিযান। খ্রিস্টধর্মের উত্থানের ফলে ১৯৬০-এর দশকে হেডহান্টিংয়ের ঐতিহ্যের অবসান ঘটে। বেশিরভাগই এখন ক্যাথলিক ধর্মে রূপান্তরিত। তবে আগের মতোই প্রকৃতি উপাসনা অব্যাহত রয়েছে। কোন্যাকরা সূর্য ও অরণ্যের কাছে প্রার্থনা করেন এখনও।

এই গ্রামটি নাগাল্যান্ডের একটি প্রধান আফিম গ্রহণকারী এলাকা। এখানে প্রচুর পরিমাণে আফিম খাওয়া হয়। তবে এই আফিম গ্রামে চাষ করা হয় না। এই আফিম মায়ানমার থেকে সীমান্ত দিয়ে পাচার করা হয়। গ্রামটির পরিবহণ ব্যবস্থা এখন বেশ উন্নত। বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন (বিআরও) কর্মীরা একটি সরু চড়াই রাস্তার মেরামত করেছে যত্ন নিয়ে। কোনো বাড়ির দেওয়ালে ফ্রেস্কো এবং কুলুঙ্গিতে পুরনো মূর্তি। কিছু বাড়ি অপরূপ নাগা-শৈলীর খড়ের ছাদবিশিষ্ট। এহেন লংওয়া ৪৪ ফোমচিং বিধানসভা এলাকার মোন জেলার ভারতীয় অংশ। অন্যদিকে, মায়ানমারের দিকে ইয়োচেন লাহে টাউনশিপ নির্বাচনী এলাকা। গ্রামটির বর্তমান চিফ অ্যাং টনেই কোন্যাক। তাঁর দুই স্ত্রী। তবে একজন ভারতীয় ভোটার টনেই। নাগাল্যান্ডের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট দিলেও মায়ানমার নির্বাচনে কখনোই অংশ নেননি। গ্রামের ইনফ্রাস্ট্রাকচার নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রধান আং-এর কর্তৃত্ব রয়েছে। চিফ অ্যাং-এর এখতিয়ারে রয়েছে একটি স্কুলও। উভয় দেশের ছেলেমেয়েরাই এখানে পড়াশোনা করে। বিদ্যালয়টি ২০১৪ সালে নির্মিত।

বহু বৈচিত্র্যের কেন্দ্রস্থল ভারতীয় উপমহাদেশ। আশ্চর্য সব গল্প ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন প্রান্তে। সীমারেখা দিয়ে যে তার মধ্যে পার্থক্য গড়া যায় না, লংওয়া গ্রামের গল্প তার আরেক উদাহরণ।

Powered by Froala Editor