লক্ষ্মীলাভ নেই লক্ষ্মীতে, বিক্রি না হলে ফেলেই দিতে হয় মূর্তি

কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো। দুর্গাপুজোর পরেই যে দিনটার দিকে চেয়ে থাকে বাঙালি। কেননা লক্ষ্মীপুজোর পরেই আবার গতে বাঁধা জীবন, ছুটির মরসুম এক অর্থে শেষ। ঘরে-ঘরে সম্পদের দেবীর আরাধনা। প্রার্থনা একটাই, যেন অধিষ্ঠিত হন তিনি। বাড়ি ছেড়ে চলে না যান যেন। এই লক্ষ্মীকে ধরে রাখার জন্য কত ছল-চাতুরির গল্প লুকিয়ে আছে আমাদের লোককথায়। কিন্তু লক্ষ্মীমূর্তি বিক্রি করেই যাঁদের লক্ষ্মীলাভ হয়, তাঁদের অভিজ্ঞতা কেমন?

পুজোর দু-তিনদিন আগে থেকেই রাস্তার ধারে, বিভিন্ন দোকানে হাজির লক্ষ্মীর ছাঁচের মূর্তি। সঙ্গে পুজোর নানা উপাচারও। দশকর্মার দোকানে ভিড়। সার দিয়ে বসে আছেন লক্ষ্মী, হাতে বরাভয়মুদ্রা। কিন্তু সেই বরাভয় কতটা আশ্বস্ত করে বিক্রেতাদের? বাপি দাসের কথায়, পুজোর আগের সন্ধ্যাতেই বিক্রি হয় বেশিরভাগ। লক্ষ্মী-সরস্বতী পুজোর আগে এই খুচরো ব্যবসা, দুটো উপরি রোজগারের তাগিদ।

কিন্তু এই যে মূর্তির দাম বাড়ছে বছরের পর বছর, ক্রেতা কমে যায় না? বাপি দাস হাসলেন – ‘লোকের হাতেও তো পয়সা বাড়ছে দাদা! আর মূর্তির দাম বাড়বে নাই বা কেন! মাটির দাম বাড়ছে, আরও ফ্যান্সি হচ্ছে লক্ষ্মীর পোশাকআশাক, দাম না বেড়ে উপায় কই!’

কিন্তু লক্ষ্মীমূর্তির ক্ষেত্রে ছাঁচের প্রাধান্য কেন? তাঁর কথায়, একদিনের পুজোয় খুব বেশি খরচা করতে চায় না মধ্যবিত্ত বাঙালি। কাজ চালানোর মতো ছোটখাটো মাপ হলেই খুশি। বাপি দাসের কাছে মূর্তি শুরু ১৭০ টাকা থেকে। একটা বিক্রি করলে ২০-৩০ টাকার মতো লাভ। আর যদি বিক্রি না হয়? তাঁর বিষণ্ণ জবাব – ‘তাহলে আর কী! ফেলে দিতে হবে! আমরা তো কুমোরের কাছ থেকে নগদে কিনে আনি! পুরোটাই রিস্কি। যদি বিক্রি না হয়, ডাস্টবিনে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর উপায় নেই। সারাবছর তো রেখে দেওয়া যায় না! এভাবেই চলছে...’

দিগন্ত বিশ্বাস অবশ্য বাপি দাসের মতো অবিক্রিত মূর্তি ফেলে দিতে পারেন না। তিনি বলেন, ‘হাজার হোক, ঠাকুরের মূর্তি তো! প্রাণে ধরে ফেলতে পারি না। দশকর্মার দোকানে দিয়ে দিই। তারা ওগুলো কুমোরদের কাছে দিয়ে দেয়। খোলা জায়গায় থাকতে থাকতে, রোদে-বৃষ্টিতে মাটি হয়ে যায় আবার। সেই মাটি দিয়েই পরের বছর...’

একটা ঘরের মধ্যে, সার দিয়ে ছাঁচের লক্ষ্মীমূর্তি সাজিয়ে রেখেছেন দিগন্তবাবু। সবচেয়ে ছোট মূর্তির দাম ১০০ টাকা, সর্বোচ্চ ৭৫০ টাকা। সঙ্গে রয়েছে বেশ কিছু লক্ষ্মীর সরাও। পুজোর তিন-চারদিন আগে, কুমোরদের কাছ থেকে নিয়ে আসেন। এও এক ইনভেস্টমেন্ট। এ-বছর কিনেছেন প্রায় ১০-১২ হাজার টাকার লক্ষ্মীমূর্তি। সব যদি বিক্রি না হয়? ‘দেখা যাক...’ – সলজ্জ উত্তর তাঁর।

অন্যদিকে, মূর্তি তৈরির কারখানায় আবার অন্যরকম ব্যস্ততা। সেখানে ছাঁচের নয়, খড় দিয়ে কাঠামোতেই তৈরি করা হয় লক্ষ্মীমূর্তি। আয়তনও সাধারণের তুলনায় বড়ই। ‘কারখানা’ই বলতে ভালোবাসেন নিজেদের মূর্তি তৈরির ঘরটিকে। তেমনই এক কুমোর প্রদীপ পাল জানালেন, লক্ষ্মীমূর্তির বিক্রি নেই বেশি। কেন? ‘আসলে লোকে এই পুজোর জন্য খুব বেশি খরচ করতে চায় না। তাই আমরা অর্ডার পেলে কিছু বানাই, আর কয়েকটা এমনিই বানিয়ে রেখে দিই। বিক্রি না হলেও চিন্তা নেই। গুদাম আছে, সেখানেই থেকে যাবে পরের বছর অব্দি।’

এই যে এত যত্ন নিয়ে কাঠামোয় মূর্তি বানান নিজে হাতে, বিক্রি না হলে কষ্ট হয় না? উত্তরে আত্মগর্ব দেখা গেল প্রদীপবাবুর চোখে-মুখে। ‘আমরা ওরকম ছাঁচের কাজে বিশ্বাসী নই। যা করব, যত্ন নিয়েই করব। তবে হ্যাঁ, মার্কেট না থাকলেও, যাঁরা বড় করে পুজো করেন, আমাদের কাছে আসতেই হয় তাঁদের।’

দুর্গাপুজোর পর, এভাবেই চলে ‘প্যারালাল’ এক ব্যবসা। নিজস্ব দোকান বন্ধ করে কেউ পাইকারি হারে কিনে আনেন লক্ষ্মী, সাজিয়ে বসে পড়েন রাস্তার ধারে। কেউ আবার কুমোরের ধর্ম মেনেই তৈরি করে রাখেন মূর্তি। সকলেরই আশা এক – খদ্দের আসুক। ঠাকুর নিয়ে দরাদরি করতে পছন্দ হয় না অনেকের। কিন্তু উপায় নেই। দুটো রোজগার হলে, সেই সুযোগ কেউ ছাড়ে! হাজার হোক, লক্ষ্মী তো! কে জানে, এ-বছরই হয়তো ভরিয়ে দিলেন কৃপায়!