কৃশানু দে ফিরলেন, সঙ্গে নিয়ে এলেন ময়দানের দমকা হাওয়া

ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বৈরথ আজকের প্রজন্মের ক'জনকে আলোড়িত করে? লিখতে বসে প্রথমেই সটান ও সপাট এই প্রশ্ন উঠে এল। যারা ফুটবলের প্রতি কৌতূহলী, তারা ছাড়া সাধারণ ‘ইয়ং ব্রিগেড’ কি যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ময়দানের ফুটবল চর্চা সম্পর্কে? খুব মন দিয়ে যারা খুঁটিনাটি অনুসরণ করে, তারা ছাড়া প্রায় কেউই বর্তমান ইস্টবেঙ্গল কিংবা মোহনবাগান দলের অধিকাংশ খেলোয়াড়ের নাম বলতে পারবে না।

অথচ বছর দশেক আগেও ছবিটা খানিক অন্য ছিল। সে-সময় ব্যারেটো-বাইচুং-শিল্টন-রহিম নবিদের নাম জানত অনেকেই। জানত আরও অনেকের নাম। আগের প্রজন্মের চুনী গোস্বামী, অমল দত্ত, পিকে ব্যানার্জি, সুব্রত ভট্টাচার্য, প্রসূন বন্দ্যোপাধ্যায় সুভাষ ভৌমিক বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্যদের সঙ্গেও পরিচিত ছিল অনেকেই, বিশেষত টেলিভিশন ও সংবাদপত্রের দৌলতে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ক্লাবের কোচ-তরজা নিয়ে শিরোনামে উঠে আসা তো রয়েইছে। এঁদের অনেকেই এখনও পরিচিত।

https://www.youtube.com/watch?v=Q_FeYfS5-Oc

কিন্তু কৃশানু দে? যিনি আশি ও নব্বই-য়ের দশকে খেলতেন, ২০০৩ সালে মাত্র ৪১ বছর বয়সে মারা গেলেন যিনি, একুশ শতকে শৈশব-কৈশোর কাটানো ক’জন তরুণ তাঁর সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল? হয়তো নাম শুনেছে ইতিউতি। কিন্তু ময়দানের ইতিহাস যার ভালোভাবে জানা নেই, আজকের বাজার-সর্বস্ব পরিচিতির যুগে সে কি বিন্দুমাত্র আন্দাজ পাবে, একসময় বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা শ্রদ্ধায় নত হতেন কৃশানু দে-র নাম শুনে?

বলা হয়, বাংলার শেষ কিংবদন্তী ফুটবলার কৃশানু দে। প্রথম বড় ক্লাব ক্যালকাটা পোর্ট ট্রাস্ট। তারপর সেখান থেকে মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গল। বারো বছরে ক্লাব বদল করেছেন বেশ কয়েকবার। শেষে, এফসিআই-এর হয়ে অবসর নেন ১৯৯৭ সালে। যদিও সোনালি সময় কাটিয়েছেন ইস্টবেঙ্গলে থাকাকালীনই। তাঁকে বলা হত ‘ভারতের মারাদোনা’। তাঁর বাঁ-পায়ের জাদুতে বারবার ছত্রখান হয়ে গেছে প্রতিপক্ষ। ১৯৮৪ থেকে ১৯৯৩ পর্যন্ত টানা ভারতের হয়ে খেলেছেন তিনি। অথচ অকালপ্রয়াণ এই ফুটবলারকে পাঠিয়ে দিল আলোচনার আড়ালে। অন্ধ ফ্যান আর ফুটবলপ্রেমী ছাড়া বিশেষ কারোর মুখেই আজ আর উচ্চারিত হন না এই ফুটবলার।

সেই কৃশানু দে-কে নিয়েই বাংলায় একটি ওয়েব সিরিজ বেরিয়েছে সম্প্রতি। নাম, ‘কৃশানু কৃশানু’। ওয়েব চ্যানেল ‘Zee 5’-এ গত ২৯ আগস্ট রিলিজ করে পাঁচটি এপিসোডের প্রথম সিজন। তার আগেও বেশ কিছুদিন যাবত গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল এই ওয়েব সিরিজটি নিয়ে। হাজার হোক, বাঙালির আবেগ কৃশানু দে-কে নিয়ে ওয়েব সিরিজ হলে সাড়া তো পড়বেই!

ওয়েব সিরিজের কাহিনি অনেকটা এরকম – সুদূর জার্মানি থেকে ক্লারা নামের এক পরিচালক কলকাতায় আসেন কৃশানু-কে নিয়ে সিনেমা বানাতে। এসে রিসার্চ চলাকালীন তাঁর দেখা হয় বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে, যাঁরা কৃশানুর সঙ্গে ওয়াকিবহাল। সেই সঙ্গে কৃশানুর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য একটি ছেলেও খুঁজছিলেন তিনি। অন্যদিকে, সেই ছেলেটি, যে কৃশানুর চরিত্রে অভিনয় করবে, তার ব্যক্তিগত জীবন দেখানো হয়েছে সিরিজে। পাশাপাশি চলেছে তাঁর অভিনীত কৃশানুর চরিত্রও। পরিচালক কোরক মুর্মু দারুণ মুনশিয়ানায় বুনেছেন বর্তমান ও অতীতের দৃশ্যগুলি।

দেখতে-দেখতে আপনার মনে পড়তেই পারে আমির খান অভিনীত ‘রং দে বাসন্তী’ সিনেমার কথা। সেই বিদেশ থেকে একজনের সিনেমা তৈরির উদ্দেশ্যে আগমন, এবং পাশাপাশি বর্তমান ও অতীতকে উপস্থাপন করা। এমন একটি কাল্ট সিনেমার ছায়া থেকে বেরিয়ে অন্যরকম প্লট কি বুনতে পারতেন না চিত্রনাট্যকার? তাতে নিজস্বতাও তৈরি হত অনেকটাই।

তবে এই ওয়েব সিরিজ নির্মাণে যত্ন ও পরিশ্রমের ছাপ স্পষ্ট। ময়দানের ভাষা, ফুটবলচর্চা ইত্যাদি যথাসম্ভব ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক। ফুটবলপ্রেমী বাঙালির মনে এসব দৃশ্য আবেগতাড়িত করে তুলবেই। ধরা পড়েছে কোচিং, দলবদল, একজন ফুটবলারের বড় হয়ে ওঠা থেকে শুরু করে তার ব্যক্তিগত জীবন – সবকিছুই। কৃশানু দে-র জীবনের অংশটি ইতিহাসের একটি নির্ভরযোগ্য দলিল হয়ে থাকতেই পারে। যথেষ্ট রিসার্চ করে এই কাজে হাত দিয়েছেন নির্মাতারা। সেদিক দিয়ে দেখতে গেলে, শুধুমাত্র গুরুত্বের কারণেই যাবতীয় সমালোচনার ঊর্ধ্বে থাকতে পারে এই ওয়েব সিরিজটি।

কৃশানুর চরিত্রে অভিনয় করেছেন মধ্যপ্রদেশের অভিনেতা অনুরাগ উরহা। তাঁর সঙ্গে কৃশানুর চেহারার সাদৃশ্য বিস্ময়কর। তবে অমন কিংবদন্তীর চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ফুটবলে দক্ষতা থাকাও আবশ্যক। সেদিকেও খামতি রাখেননি অনুরাগ। এছাড়াও অন্যান্য চরিত্রে ইলিনা কাজান, বাদশা মৈত্র, দেবেশ রায়চৌধুরীরা আশাহত করেননি। একঝাঁক তরুণ অভিনেতা-অভিনেত্রী কাজ করেছেন এই ওয়েব সিরিজে। তাঁদের মধ্যে জিৎ সুন্দর চক্রবর্তী, রাজেশ্বরী পাল, অনুজয় চট্টোপাধ্যায়, শ্রেয়া ভট্টাচার্য-রা যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন কাহিনি ও স্ক্রিপ্টের।

তবে সব ভালোর মধ্যে কিছু খারাপও লুকিয়ে থাকে। ডাবিং একদমই আশানুরূপ নয়। পর্দায় যা দেখা যাচ্ছে, তার সঙ্গে ডায়লগের প্রেজেন্টেশন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বড় কৃত্রিম শোনায়। অভিনয়ের মানের সঙ্গে যেন বেমানান কথার উপস্থাপনা। অনেক ডায়লগের উপস্থাপনাই বড্ড ফ্ল্যাট। ভয়েস মডিউলেশনের অভাব বিশ্বাসযোগ্যতার থেকে দূরে নিয়ে যায় দর্শককে। কৃত্রিমতার ছাপ ফুটে ওঠে স্পষ্ট। সেই ছাপ দেখা গেছে বেশিরভাগ পূর্ববঙ্গীয় ভাষার উচ্চারণেও। অভিনেতাদের আরও আয়ত্ত করা উচিৎ ছিল সেই ভাষা। কোনো স্বাভাবিক বাঙাল পরিবারই এমন মেকি ভাষায় কথা বলে না। আর, বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে প্রচুর স্ল্যাং ব্যবহৃত হয়েছে এই ওয়েব সিরিজে। তাতে আপত্তি নেই, কেননা সাধারণ সমাজে এমনটাই দেখা যায়। কিন্তু আজ অবধি কাউকে এত পরিশীলিত ও মার্জিত উচ্চারণে গালাগাল দিতে শুনিনি। গোটা-গোটা স্পষ্ট অক্ষরে গালাগাল দেওয়া শুনে, মনে হচ্ছে যেন ডাবিং-এর সময় স্বতঃস্ফূর্ততা ছেড়ে গালাগালির শব্দগুলিকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন অভিনেতারা। এক কথায় বলতে গেলে, এই ওয়েব সিরিজের শ্রাব্য অংশগুলি আরও অনেক যত্নে ও বাস্তবোচিতভাবে নির্মাণ করা যেতে পারত।

কিন্তু ওই যে বললাম, কোথাও বাঙালির ফুটবল-আবেগের কাছে ম্লান হয়ে যায় সব খুঁতই। আজকের প্রজন্ম হাজার ইউটিউব ঘেঁটেও কৃশানুর খেলার ভালো কোনো ক্লিপিং দেখতে পাবে না। সেখানে এই ওয়েব সিরিজ যদি বাংলার শেষ ফুটবল লেজেন্ডের জীবন তুলে আনে, তাই বা কম কী! কিছু না থাকার থেকে এও তো ভালো...

ছবি ঋণ - Zee 5