‘মুসলমানদের ঘর ভাড়া দেওয়া হয় না’; যে সামাজিক ব্যাধি গ্রাস করছে কলকাতাকেও

মুখে দাড়ি এবং মাথায় ফেজ টুপি। নামের মধ্যে আরবি বা ফারসি শব্দ। বোঝা যায়, ধর্মসূত্রে তাঁরা মুসলমান। আর এই ‘অপরাধে’ই আজও মাথার উপর আশ্রয় খুঁজে পান না অনেকেই। গতকাল সল্টলেকের একটি গেস্ট হাউস থেকে এই অপরাধেই বের করে দেওয়া হয় ১০ জন শিক্ষককে। তাঁরা প্রত্যেকেই মাদ্রাসা শিক্ষক। কাজের সূত্রেই আসতে হয়েছিল কলকাতায়। কিন্তু এখানে এমন হেনস্থার মুখে পড়তে হবে, ভাবেননি কেউই। তবে এই ঘটনা কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। কলকাতা ও তার আশেপাশের এলাকায় এরকম ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। হয়তো সব খবর প্রচারের আলোয় আসে না।

“এই ঘটনা নতুন কিছু নয়। আমরা যখন রবীন্দ্রভারতীতে পড়তাম, তখন অনেক বন্ধুকেই দেখতাম নাম ভাঁড়িয়ে মেসে থাকছে। প্রকৃত নাম বললে তাদের মেসে থাকতে দেওয়া হবে না বলে ভয় পেত।” বলছিলেন প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান মোস্তাক আহমেদ। “যদিও সাম্প্রতিক সময়ে এই অবিশ্বাস আরও গাঢ় হচ্ছে। কানের কাছে সবসময় একই প্রচার চলতে থাকলে মানুষের মনের মধ্যেও তো ভয় ঢুকে যাওয়া স্বাভাবিক।” বলছিলেন তিনি।

গ্রাম-মফঃস্বল থেকে কলকাতায় পড়াশোনা করতে আসা ছাত্রছাত্রীদের তো হামেশাই এরকম সমস্যার মুখে পড়তে হয়। তনভি সুলতানা নামের এক ছাত্রী তেমনই আশুতোষ কলেজের বায়োটেকনোলজি বিভাগে পড়াশোনা করতে এসেছিলেন। ২০১৮ সালের ঘটনা। “একদিনে তিনটে ঘর খুঁজতে গিয়েছিলাম। প্রথম বাড়িওয়ালা হাতজোড় করে জানিয়েছিলেন, আপনাকে থাকতে দিলে প্রতিবেশীরা আপত্তি জানাবে। দ্বিতীয়জন বলেছিলেন, আমরা মহামেডানদের থাকতে দিই না। তৃতীয়জনের সঙ্গে সব কথাবার্তা হয়ে যাওয়ার পর অ্যাডভান্স টাকা পেমেন্ট করার আগে আমি নিজে থেকেই নাম বলি। তখন তিনিও না করে দেন।” বলছিলেন তনভি। “পরে কলেজের কিছু সিনিয়র দাদাকে বিষয়টা জানালে তারা ঘরের ব্যবস্থা করে দেয়। কিন্তু আজও যাদবপুর এলাকার অনেক ব্রোকার প্রথমেই জানিয়ে দেন, মহামেডান হলে ঘর পাওয়া মুশকিল।” কলকাতার অন্যতম ‘শিক্ষিত’ এলাকা নামে পরিচিত যাদবপুরের অবস্থাই যদি এরকম হয়, তাহলে সামগ্রিক চেহারা আন্দাজ করা কঠিন নয়।

কলকাতা ছাড়িয়ে শহরতলির ছবিটাও একইরকম। বলছিলেন কবি, সম্পাদক ও প্রকাশক সেলিম মন্ডল। “আমরা কলেজে পড়ার সময় বেলঘড়িয়ার একটা মেসে থাকতাম। আমাদের সঙ্গে কয়েকজন গ্রামের ছেলে থাকত, তারা নিয়মিত নামাজ পড়ত। মানে যেমন ধর্মাচরণ করে সবাই। আমরা যদিও সেসব করতাম না। কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারি মেস মালিক তাদের পছন্দ করছেন না। সরাসরি কিছু বলতে না পেরে গ্যাস চুরির অপবাদ দিয়ে তাদের তুলে দিতে চান।” এরকম নানা ঘটনাই ঘটে চলেছে চারিদিকে। মাত্র মাস তিনেক আগে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী অন্বেষা কুণ্ডু ঘর ভাড়া খুঁজতে যান পার্ক-সার্কাস অঞ্চলে। তখন সবে আনলক পর্যায় শুরু হয়েছে। অতএব নতুন ঘর ভাড়া পাওয়া নিয়ে সমস্যা হচ্ছিলই। “ওই বাড়িটিতে কিন্তু এরকম কোনো সমস্যা ছিল না। কমপ্লেক্সের বাকিদের নাকি এই নিয়ে কোনো আপত্তিই নেই। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রশ্ন করে বসলেন, আমি হিন্দু কিনা। তারপর বললেন, “নাহলে, মানে, বুঝতেই পারছেন…” জানি না, কী বোঝার কথা বলেছিলেন তিনি।”

আরও পড়ুন
দোল উপলক্ষে রং বিক্রি মুসলমান দোকানির, কলকাতার নাখোদা মসজিদ চত্বরে সম্প্রীতির দৃশ্য

শুধু ঘর ভাড়া বা গেস্ট হাউসের কথা বললেই অবশ্য হয় না। সব মিলিয়েই একটা সন্দেহ যেন সবসময় তাড়া করে বেড়ায়। মুসলমান মানেই সন্ত্রাসবাদী, এরকম একটা ধারণা যেন সমাজের মনঃতত্ত্বের মধ্যে ঢুকে গিয়েছে। আরেক কবি সেখ সাহেবুল হক বলছিলেন, “কয়েকজন আরবি নামধারী জঙ্গি ধরা পড়া মানে 'সব মুসলমানই জঙ্গি' জাতীয় একপেশে প্রচারের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়াতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিন্নমত পোষণকারীকে প্রমাণ ছাড়া 'জঙ্গি' বলে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতাও বিপজ্জনক। সেক্ষেত্রে বিদ্বেষ এবং বিভেদের রাজনীতির রাস্তা সহজ হয়।” এমনকি অনেক ক্ষেত্রে প্রশাসনও মিথ্যা সন্দেহের বসে অনেককে গ্রেপ্তার করে বসে বলে জানাচ্ছেন তিনি। “গত বছরেই রাজস্থানে এমন একটি ঘটনা ঘটে। সেখানে এক কাশ্মীরি যুবক জঙ্গি সন্দেহে গ্রেফতারের ২৩ বছর পর প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পান৷ এমন আরও কিছু উদাহরণ রয়েছে যেখানে নির্দোষ ব্যক্তির জীবন শেষ হয়ে গেছে। জঙ্গি কার্যকলাপে জড়িত দোষীদের সাজা দেওয়ার পাশাপাশি নির্দোষ ব্যক্তিদের হয়রানি যাতে না হয় সেদিকেও দেখা প্রয়োজন।”

এই সার্বিক সন্দেহ আর অবিশ্বাসের পরিবেশ সমাজকেই ভিতর থেকে বিষাক্ত করে তুলছে। মানুষে মানুষে স্বাভাবিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অধ্যাপক মোস্তাক আহমেদের কথায়, “এই পরিবেশে আমরা সবসময় প্রশাসন আইনের উপর ভরসা রাখতে শুরু করছি। কিন্তু সমাজ তো এভাবে চলতে পারে না। সমাজকে এগোতে হবে মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতেই। সেটা নড়বড়ে হয়ে গেলে পরিস্থিতি ভয়ানক হয়ে উঠবে।” তাই শেষ পর্যন্ত আমাদের দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ভাবমূর্তিকে তুলে ধরা বিশেষ প্রয়োজন। প্রয়োজনে সমস্ত মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে এই লড়াইতে। এমনটাই মনে করছেন শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষরা। প্রথাগত শিক্ষা যে সাম্প্রদায়িকতার বিষদাঁত উপরে ফেলতে পারেনি, সেটা তো দেখাই যাচ্ছে। তাই শেষ পর্যন্ত ভরসা রাখতে হবে গণশিক্ষার উপরেই। মানুষের কৌম যাপন এই বিষাক্ত পরিবেশকে স্বাভাবিক করে তুলতে পারবে নিশ্চই।

আরও পড়ুন
মুসলমানের দোকান থেকে বিস্কুট কেনা ‘অপরাধ’, ছাত্রদের নিন্দায় মুখর বঙ্গসমাজ

Powered by Froala Editor

More From Author See More