বাবুদের আমলে, ‘ন্যাংটো কার্তিক’-এর পূজা শুরু হয় কাটোয়ার বেশ্যাপল্লিতে

বাংলা মাসগুলির মধ্যে একমাত্র কার্তিক মাস বাদ দিয়ে আরও কোনও মাসের নাম কোনও দেবতার নামে উৎসর্গ করা হয়নি। আদিকাল থেকেই বাংলা মাসগুলিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাস হল কার্তিক মাস। হেমন্তকালের মাস কার্তিকই ছিল প্রাচীনবাংলার সমাজে বছরের প্রথম মাস এবং লক্ষ্মীর পাশাপাশি কার্তিকই ছিলেন প্রধান দেবতা। এই কার্তিক কিন্তু মা দুর্গার সন্তানরূপে পূজিত কার্তিক নন, বরং প্রজনন ও কৃষির দেবতা তথা রাঢ়দেশীয় কৃষিসংস্কৃতির প্রধান প্রতিভূ। তাই রাঢ়বঙ্গে অঘ্রান মাসে নবান্নের প্রধান দেবতাও কার্তিক (যদিও দেবী অন্নপূর্ণাকেও দেখা যায় কিছু কিছু জায়গায়)।

অঘ্রান মাসেই বাঙালি চাষির ঘরে থাকত ফসলের প্রাচুর্য, তাই মুঘল আমল থেকেই পয়লা অঘ্রান ছিল বাঙালি নববর্ষ।  মূলত কৃষিপ্রধান ও নদীতীরবর্তী অঞ্চল শস্য উৎপাদনে শ্রেষ্ঠ হয় বলেই গঙ্গা তীরবর্তী কাটোয়া, পূর্বস্থলী ও বাঁশবেড়িয়া অঞ্চলে আদিকাল থেকে কার্তিক পূজার খ্যাতি দেখা যায়। কাটোয়া মহকুমার গ্রামাঞ্চলে কৃষিদেবতা রূপে পূজিত হলেও শহর কাটোয়ার সঙ্গে কার্তিক জড়িয়ে আছেন বণিক ও বারবনিতাদের সম্মিলিত প্রয়াসের সঙ্গে। কাটোয়া মহকুমার কার্তিক মূলত ন্যাংটা কার্তিক বা খোকা কার্তিক, যে কার্তিক মনুষ্য সমাজে শিশু রূপে পূজিত হন। তাই তার আদুরে নাম 'খোকা'। একজন শিশুকে ভুলিয়ে রাখার মতো এই কার্তিককে পূজায় দিতে হয় বিভিন্ন ধরণের খেলনা, বেলুন, মোয়া, কদমা, লাড্ডু। মানতকারী মানুষের শিশুলাভের কামনা থেকেই এই উপকরণগুলিকে পূজায় উঠে এসেছে বলে মনে করা হয়।

তবে এই সবকিছুর পেছনে লুকিয়ে আছে বণিক ও বারবনিতাদের গল্প। সেই গল্প খুঁজতে আমাদের যেতে হবে সুদূর প্রাচীনে সমৃদ্ধ নগর কাটোয়ায়। যখন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভা ঘুরে ভারতভ্রমণে বের হয়েছিলেন সেলুকাসের দূত মেগাস্থিনিস, যিনি উত্তর ভারত, পূর্ব ভারত ঘুরে এসে দাঁড়িয়েছিলেন ভাগীরথী ও অজয়ের সংগমস্থলে কটদূপার(কাটোয়া) ঘাটে। পরে সেই সমৃদ্ধ কাটোয়া মুর্শিদাবাদের নবাবের নজরে পড়লে তার গুরুত্ব আরও বেড়ে যায়। রাজনীতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিকভাবে কাটোয়ার গুরুত্ব হু হু করে বাড়তে থাকে। পরবর্তীতে ব্রিটিশ সরকার ভাগীরথীতে স্টিমার চালালে কাটোয়ার ঘাট হয়ে ওঠে রাতবেরাতে জলদস্যুদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার প্রধানতম আশ্রয়স্থল। ক্রমেই কাটোয়ার ঘাটের গুরুত্ব বেড়ে যায়, যার উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮৬০ দশকে সিভিল সার্ভেন্ট ভোলানাথ চোঙদারের লেখা ‘ট্রাভেল অফ এ হিন্দু’ বইয়ে।

সেসময় মেসার্স হোর অ্যান্ড মিলারের তত্ত্বাবধানে ভাগীরথীতে চলা স্টিমারে কাটোয়ার আসতে শুরু করল লবণ, রান্নার মশলা এবং কাটোয়া থেকে রপ্তানি হতে শুরু হল কাঁসা-পিতলের বাসন ও অন্যান্য সামগ্রী। ভাগীরথী তীরে লবণের ব্যবসা জমে উঠল বিপুলভাবে। সেই ব্যবসাকে কেন্দ্র করেই কাটোয়ার একটা ঘাটের নাম হল লবণগোলা ঘাট। প্রধানত চন্দ্র বংশীয় ব্যবসায়ীরাই এগুলোর নেতৃত্ব দিতে শুরু করল, পরে তাদের সঙ্গে যোগ দিলেন স্থানীয় কিছু জমিদার ও ধনাঢ্য ব্যক্তিরা। তাতে কাটোয়ার ঘাটে এসে ভিড় করতে শুরু করল দেশ বিদেশের বিভিন্ন বণিকদের দল, বড়ো বড়ো বজরার মালিক ও শ্রমিকরা। খাদ্য, আশ্রয়স্থলের পাশাপাশি তাদের কাছে সুগম্য হতে শুরু করল ভাগীরথী তীরবর্তী একটি বারবনিতাপল্লিও, যার অবস্থান ছিল হরিসভা পাড়াতে। অনেকে মতে, বর্গীদের আক্রমণে কাটোয়া ও কাটোয়ার নিকটবর্তী গ্রামের অসংখ্য নারী ধর্ষিত হলে, তারা সামাজিকভাবে প্রান্তিক হয়ে পড়ে। পরে তারাই সম্মিলিতভাবে একটি নিষিদ্ধপল্লি গড়ে তোলে, যা পরবর্তীতে ভাগীরথী নদীর পাশে বিদেশি বণিকদের বিনোদনের স্থান হিসাবে প্রাধান্য লাভ করে।

মূলত এই বারবনিতাদের সন্তানলাভের ঈপ্সিত কামনা ও স্থানীয় বণিকদের অর্থের প্রাচুর্যদের প্রদর্শনের জন্যই নিষিদ্ধপল্লিতে পূজিত হতে শুরু করে ন্যাংটো কার্তিক। বণিকরা ছিল নিষিদ্ধপল্লির 'বাবু', যে বাবুদের আভিজাত্যে প্রদর্শনের প্রতিযোগিতা, কোন বাবু বেশি খরুচে, কোন বাবু শ্রেষ্ঠ - এই বার্তা প্রতিষ্ঠার জন্যেই প্রত্যেক বাবু তার ঠাকুরের জন্য আলাদাভাবে বিচিত্র আলোক প্রদর্শন ও শোভাযাত্রার আয়োজন শুরু করে। এই শোভাযাত্রা ধীরে ধীরে আভিজাত্যের লড়াইয়ে পরিণত হয়, যা আজকের ক্লাবভিত্তিক কার্তিক লড়াই।

এই শোভাযাত্রাতে আগেকার মতো আজও স্থান 'থাকা'র প্রদর্শন। থাকা হল পুরাণের গল্পের ভিত্তিতে অনেকগুলি পুতুলের একসঙ্গে একই কাঠামোতে প্রদর্শন। এই 'থাকা'-তে ফুটে ওঠে পুরাণের গল্পের ভিত্তি করে হিরণ্যকশিপু বধ, দেবরাজ ইন্দ্রের সভাসদসহ রাজসভা, অর্জুনকে কৃষ্ণের বিশ্বদর্শন করানোর মতো চিত্রকল্প। যুগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে থিমের পূজা হলেও থাকার চল আজও আছে সাবেক কাটোয়ার পূজাগুলিতে, যেমন শাঁখারি পট্টির থাকা, ঝংকার ক্লাবের থাকা প্রভৃতি। তবে থিমের পূজাতেও অনন্য প্যান্ডেল আর প্রদর্শনীর সাক্ষী থেকে চলেছে জয়শ্রী, জনকল্যাণ, দেশবন্ধু, ইউনিক, সংহতি বা পানুহাটের নিউ আপনজনের মতো ক্লাবগুলি।

এখানে পুজোর পরেরদিন সেই আগেকার প্রথামতোই সন্ধ্যাতে নিজেদের ঠাকুর বের করে শোভাযাত্রার লড়াই হয়। শুধু পানুহাটের লড়াই শহর কাটোয়ার লড়াইয়ের পরেরদিন হয়। তবে কাটোয়ার সবচেয়ে পুরনো কার্তিক হল কাশীগঞ্জ পাড়ার বাংরা-কার্তিক। এছাড়াও তাঁতিপাড়ার সাত ভাই কার্তিক, রাজা কার্তিক, সুবোধ স্মৃতির মোড়ের জামাই কার্তিক উল্লেখযোগ্য। সুবোধ স্মৃতি রোডে উইলিয়াম কেরি জুনিয়রের স্মরণে আজও করা পূজিত হন সাহেব কার্তিক। এখানেই সমাধি আছে উইলিয়াম কেরি জুনিয়রের। বর্তমানে কাটোয়ায় প্রায় তিনশোর কাছাকাছি পূজা হয় যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাবেকিয়ানা ও আধুনিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে কাটোয়ার কার্তিক লড়াই হয়ে হয়েছে মানুষের উৎসব তথা কাটোয়া লোক-উৎসব।

More From Author See More