সৌন্দর্যায়নের নামে ইতিহাসকেই অস্বীকার? বিতর্ক জালিয়ানওয়ালাবাগে

অপ্রশস্ত প্রবেশপথের দুধারে অসংখ্য হাসিমুখ মানুষের ম্যুরাল। সেই পথ পেরিয়ে গেলেই এক সুউচ্চ জমকালো মনুমেন্ট। মনুমেন্টকে ঘিরে সুন্দর বিদেশি ফুলের বাগান। বিকেল হলেই লেজারের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে উঠছে সেই মনুমেন্ট। ঠিক যেন একটা সাজানো গোছানো উদ্যান। সপ্তাহান্তের অবসর কাটাতে সেখানে যাওয়াই যায়। নাম কী এই উদ্যানের? জালিয়ানওয়ালাবাগ। হ্যাঁ, ১০২ বছর আগের সেই কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডের জালিয়ানওয়ালাবাগ। কিন্তু আজ সেখানে গেলে কি সত্যিই সেই ইতিহাস মনে পড়বে কারোর? কেন্দ্র সরকারের সাম্প্রতিক নবরূপায়ণ কর্মসূচিকে ঘিরে এমন প্রশ্নই তুলছেন ঐতিহাসিক থেকে শুরু করে নাগরিক সমাজের অনেকেই।

জালিয়ানওয়ালাবাগের শতবর্ষপ্রাচীন ফলকটি বেশ কয়েক বছর আগেই নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ২০১৯ সালে হত্যাকাণ্ডের শতবর্ষ উপলক্ষে সমগ্র এলাকাটির নবরূপায়ণের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই খাতে ২০ কোটি টাকা খরচ করার সিদ্ধান্তও নিয়েছিল কেন্দ্র। কেন্দ্রের এই উদ্যোগকে সেই সময় স্বাগত জানিয়েছিলেন অনেকেই। কিন্তু ২ বছর বন্ধ থাকার পর ২৮ আগস্ট জালিয়ানওয়ালাবাগের দরজা খুলে যেতেই চমকে ওঠেন সবাই। এই প্রসঙ্গে জওহরলাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক চমন লালের বক্তব্য, আসলে জালিয়ানওয়ালাবাগের ইতিহাসকেই মুছে ফেলার চেষ্টা করছে সরকার। একইভাবে সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দেগেছেন লন্ডনের কুইন মেরি কলেজের অধ্যাপক কিম ওয়েগনার। টুইটারে সরাসরি জানিয়েছেন, জালিয়ানওয়ালাবাগের বীভৎস স্মৃতি মুছে ফেলে তাকে রীতিমতো পার্কে পরিণত করেছে সরকার। জার্মানির এক স্থপতি ব্যাঙ্গের সুরে বলেছেন, ভারতের আর্কিটেক্টদের উচিৎ হলোকাস্ট মিউজিয়াম থেকে ঘুরে আসা। তাঁরা জানেন না যে উচ্চমানের আর্কিটেক্টের কাজ সবসময় সুন্দর করে তোলা নয়, তার বিষয়বস্তুকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা।

ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন বিরোধীরাও। তবে পাঞ্জাবের প্রবীণ লেখক প্রকাশ সিং ভাট্টি মনে করেন, শুধু বর্তমান সরকারের সমালোচনা করলে তা ভুল হবে। ৮৩ বছরের লেখক তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে লিখেছেন, ১৯৬১ সালে প্রথম জালিয়ানওয়ালাবাগের নবরূপায়ণ ঘটানো হয়। সেই সময় থেকেই একটু একটু করে মুছে ফেলা হচ্ছে হত্যাকাণ্ডের স্মৃতি। আসলে ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের মরণপণ লড়াইকে প্রত্যেকেই শুধু ভোটের অঙ্কে ব্যবহার করেছেন। রাজনৈতিক দলের নেতারা কোনোদিন সেই লড়াইকে শ্রদ্ধা করতে শেখেননি। এই প্রসঙ্গে বিতর্ক উস্কে দিয়ে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী অমরিন্দর সিং জানিয়েছেন, তাঁর বেশ ভালোই লেগেছে এই নতুন সাজ।

এএসআই এবং এনবিসিসি-র পক্ষ থেকে অবশ্য সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলা হয়েছে, হত্যাকাণ্ডের সমস্ত ছাপ যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। সেইসঙ্গে সেদিনের বৈশাখী উৎসবের প্রেক্ষাপটকেও মানুষের সামনে হাজির করার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। বলা বাহুল্য, কর্মচারীদের এই কথাকে গুরুত্ব দিতে রাজি নন কেউই। প্রশ্ন উঠছে জালিয়ানওয়ালাবাগের কুয়োটিকে কাচ দিয়ে ঢেকে ফেলা নিয়েও। প্রাণ বাঁচানোর সামান্য আশা নিয়ে সেই কুয়োয় লাফিয়ে পড়েছিলেন অসংখ্য নরনারী। ইতিহাসের সমস্ত উপাদানই সাজানো রয়েছে, শুধু নেই জেনারেল ডায়ারের নৃশংসতার কোনো নমুনা। ব্রিটিশ সরকারের হিসাব অনুযায়ীই সেদিন মাত্র ১০ মিনিটের মধ্যে হত্যা করা হয়েছিল প্রায় ৪০০ মানুষকে। আর প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে সংখ্যাটা ১ হাজারের কম নয়। শতবর্ষ পেরিয়ে এসে সেই ইতিহাস আজ শুধুই পাঠ্যপুস্তকে বন্দি। বাস্তবের মাটি থেকে তার ছাপ মুছে গিয়েছে পুরোপুরি।

আরও পড়ুন
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড – রবীন্দ্রনাথ এবং গান্ধীজি

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
অর্থ তছরুপ ও জালিয়াতিতে দোষী মহাত্মা গান্ধীর প্রপৌত্রী!