শেষ হতে চলল একটা দশক, ফিরে দেখা তারই কিছু মুহূর্ত

শেষ হতে চলেছে আরও একটা বছর। তবে শুধু বছর নয়, সেই সঙ্গে একটা দশকও শেষ হচ্ছে। ২০১৯ পেরিয়ে আমরা ঢুকব ২০২০-তে। এই একটা দশকে নানা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে গেছে পৃথিবীতে, ভারতে তো বটেই। যার প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে সব জায়গায়। সেইরকমই কিছু ঘটনার ঝলক থাকল আপনাদের জন্য—

২০১২ আর ২০১৬ মিলিয়ে অলিম্পিকে ভারতের আটটা পদক

মোট দুটো অলিম্পিক দেখেছে এই দশক। আর সেখানেই অন্যান্য বছরের তুলনায় ভাল ফল করল ভারত। ২০১২ এবং ২০১৬— দুটি অলিম্পিক মিলিয়ে আটটি পদক জিতলেন ভারতের ক্রীড়াবিদরা। ২০১২-এর লন্ডন অলিম্পিকে ২টি রুপো এবং ৪টি ব্রোঞ্জ, এবং ২০১৬-এর রিও ডি জেনেইরো অলিম্পিকে একটি করে রুপো ও ব্রোঞ্জ পায় ভারত। বিগত দশকে শুটিং, ব্যাডমিন্টন, কুস্তি, বক্সিং ইত্যাদিতে ভাল ফল করেছে ভারত। অন্যান্য খেলাতেও ছাপ রেখেছে। আগামী দিনে আরও ভাল ফলের আশায় আমরা সবাই।

বিশ্বের বেশ কিছু দেশে সমকামিতা এবং সম লিঙ্গের বিবাহ বৈধ

২০১৮ সাল। সমকামিতাকে ‘ক্রিমিনাল অফেন্স’ তকমা থেকে মুক্ত করল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। ব্রিটিশ আমলের ৩৭৭ ধারাকে রদ করা হল। তবে ‘এলজিবিটি রাইটস’ আন্দোলনের ক্ষেত্রে এই গোটা দশকটাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অনেক জায়গাতেই সমকামিতা বৈধ হয়েছে। শুধু তাই নয়, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, আর্জেন্টিনা, আয়ারল্যান্ড, গ্রিসে প্রথমবারের জন্য সম লিঙ্গে বিবাহকে আইনসিদ্ধ করা হয়। বাদ যায়নি আমেরিকাও। এই পুরো ঘটনাবলি আন্দোলনকে এক অন্য মাত্রায় নিয়ে গেল।

আইসিস

ইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া। সংক্ষেপে, আইসিস। এই একটা নাম গোটা দশকে ত্রাস হয়ে উঠে এসেছিল। নির্বিচারে মানুষ হত্যা, মুণ্ডচ্ছেদ, নগর ধ্বংস, নাশকতা— প্রায় সমস্ত রকম সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মে লিপ্ত ছিল এই জঙ্গিগোষ্ঠী। ইরাক, সিরিয়া তো বটেই, ফ্রান্স, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া-সহ বিশ্বের নানা প্রান্তে নাশকতামূলক কাজ করে এই গোষ্ঠী। ২০১৯-এ মার্কিন বাহিনীর আক্রমণের সময় আইসিসের প্রধান আবু বাকর আল-বাগদাদি আত্মঘাতী হন। কিন্তু এখনও মুছে যায়নি আইসিস। সন্ত্রাসবাদের আরও ভয়ংকর সংজ্ঞা তৈরি করেছে যারা।

মধ্য প্রাচ্যে যুদ্ধের পরিস্থিতি ও গৃহযুদ্ধ

২০১১ সাল। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সিরিয়ায় শুরু হয় অশান্তি। যা বাঁক নেয় গৃহযুদ্ধে। তবে শুধু একটি দেশেই থেমে থাকে না সেটা। লেবানন, আরব, ইরান, এবং পরে ইজরায়েল— মধ্যপ্রাচ্যের একের পর এক জায়গায় আগুন জ্বলতে থাকে। তাতে অংশ নেয় আমেরিকা, রাশিয়া। সঙ্গে যুক্ত হয় আইসিসও। যুদ্ধ, ট্যাঙ্ক, মিসাইল— এই সবকিছুর মধ্যে মারা যেতে থাকে একের পর এক সাধারণ মানুষ। গোটা দশক জুড়ে অন্যতম প্রধান ইস্যু হয়ে থাকল এই যুদ্ধ। এখনও যা স্বাভাবিক হয়নি।

শরণার্থী সমস্যা  

এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম বড় সমস্যা হল শরণার্থী। এখনও গোটা বিশ্বে ২২.৫ মিলিয়ন শরণার্থী রয়েছে। রোহিঙ্গা তো বটেই, আমেরিকা ও ইউরোপের বিস্তীর্ণ জায়গায় এই ইস্যু মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। দক্ষিণ সুদান, আফগানিস্থান, মায়ানমার, সিরিয়া, ইরাক, আফ্রিকার নানা দেশ— লিস্ট অনেক লম্বা। অনেকে মারাও যাচ্ছেন, সেই দলে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই আছেন। কী সমাধান এর? এত মানুষ কোথায় যাবে? উত্তর নেই। সমস্যার সমাধানও নেই।

পরিবেশ আন্দোলন

এই গোটা দশকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় উঠে এসেছে পরিবেশ। পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা, প্রচার, আন্দোলন যেমন বেড়েছে, তেমনই থামেনি পরিবেশ দূষণ। আমাজন-সহ পৃথিবীর নানা জায়গায় ঘন জঙ্গল পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পৃথিবী গরম হচ্ছে আরও। সেই সঙ্গে বাড়ছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যাও। ভারতও এই সবদিকে পিছিয়ে নেই। আবার এই দশকেই উঠে এসেছে গ্রেটা থানবার্গের মতো নাম। পরিবেশ বাঁচানোর আন্দোলন দানা বেঁধেছে ব্যাপকভাবে।

হিগস বোসন, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ, ব্ল্যাক হোলের ছবি-সহ উল্লেখযোগ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণা

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও এই দশক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদম শুরুতেই, ২০১২ সালে সার্নে লার্জ হাইড্রন কোলাইডারে হিগস বোসন কণার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়। পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে এটি অন্যতম যুগান্তকারী গবেষণা। এছাড়াও, মহাকর্ষীয় তরঙ্গ বা গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ সংক্রান্ত গবেষণাও করা হয়। এই দশকেই প্রথমবারের জন্য ব্ল্যাক হোলের আসল ছবি তোলা সম্ভব হয়। কোয়ান্টাম কম্পিউটারের ভাবনাও বের করা হয়। সব মিলিয়ে, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও অন্যতম উল্লেখযোগ্য দশক এটি।

ভারতের ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয়

২ এপ্রিল, ২০১১। ভারতবাসী কখনই ভুলতে পারবে না এই তারিখটি। ১৯৮৩-এর দীর্ঘ ২৮ বছর পর, ২০১১ সালে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জয় করে ভারত। তাও, ঘরের মাটিতে, শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে। স্বপ্ন সফল হল সচিন তেন্ডুলকরের। স্বপ্ন সফল হল ১২০ কোটি ভারতীয়ের। গোটা টুর্নামেন্টেই ভারতীয় দলের পারফরম্যান্স ছিল দেখার মতো। আর একদম শেষে, ভারতের অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির সেই ছয়, অনেকদিন কপিবুকে থেকে যাবে আমাদের।

ট্রাম্পের প্রেসিডেন্টশিপ এবং ইমপিচমেন্ট

বারাক ওবামা’র পর, আমেরিকার হোয়াইট হাউজের দখল নিয়েছিলেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে এমন সব সিদ্ধান্ত নিতে আরম্ভ করলেন, যে অচিরেই বিতর্কের ঝড় উঠল। কিন্তু তিনি তো ট্রাম্প, এ সব থোড়াই কেয়ার করেন উনি! কিন্তু শেষ পর্যন্ত, বিধি বাম। ২০১৯-এ, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রাক্কালে ট্রাম্পের ইমপিচমেন্টের পক্ষে সায় দিল আমেরিকার হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভ। অ্যান্ড্রু জনসন, বিল ক্লিনটনের পর তৃতীয় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইমপিচ হতে যাচ্ছেন তিনি। ট্রাম্প নাছোড়বান্দা, কিন্তু এখন তো কিছুই আর করার নেই!

ভারতের বর্তমান সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও দেশজোড়া ছাত্র আন্দোলন

এই দশক ভারতের রাজনীতির প্রেক্ষিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দশক। কেন্দ্রে শাসনক্ষমতায় নরেন্দ্র মোদী ও বিজেপি’র প্রবলভাবে উঠে আসা, এবং তারপরের সাম্প্রদায়িক রাজনীতি গোটা দশককে নিয়ন্ত্রণ করল। অর্থনীতির অবস্থা বেহাল, কর্মসংস্থান নেই— কিন্তু সেসব সরিয়ে উঠে এল ধর্মীয় আগ্রাসন। উঠে এল নাগরিকত্ব ইস্যু। শুধু কেন্দ্র নয়, অনেক রাজ্যেও এমন বহু ঘটনা ঘটেছে। অবনতি ঘটেছে নারী সুরক্ষার। আর এই পরিস্থিতিতে নতুন করে জোরালো হয়েছে ছাত্র আন্দোলন। জেএনইউ, জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সমস্ত আন্দোলনের সামনে ছিল। হোক কলরব, আজাদি ইত্যাদি শ্লোগানে প্রতিবাদের নতুন তাজা স্বর খুঁজে পেয়েছে ভারত।