করোনায় প্রয়াত মানবতাবাদী নেতা মৌলানা ওয়াহিউদ্দিন খান

১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর। ভারতের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে এক গুরুত্বপূর্ণ দিন। দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে চলে আসা রাম মন্দির বনাম বাবরি মসজিদ বিতর্ক এক হিংসাত্মক চেহারা নিয়ে হাজির হল। ভারতে এবং ভারতের বাইরে নানা স্তরে শুরু হল বিতর্ক। এমনকি এখন, প্রায় ৩ দশক পরে, সুপ্রিম কোর্টের অন্তিম শুনানির পরেও সেইসব বিতর্ক চলছেই। তবে মন্দির বনাম মসজিদ বিতর্কের বাইরে বেরিয়ে সার্বিক মৈত্রীর কথাও শুনিয়েছিলেন কয়েকজন মানুষ। তাঁদেরই একজন মৌলানা ওয়াহিউদ্দিন খান। সারা পৃথিবী অবাক হয়ে গিয়েছিল তাঁর বক্তব্য শুনে। দেশের ইসলাম ধর্মাবলম্বী সমস্ত মানুষের উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, তাঁদের হাতেই নির্ভর করছে শান্তি রক্ষার দায়িত্ব। এমনকি প্রয়োজনে বাবরি মসজিদের অধিকার ছেড়ে দিতেও প্রস্তুত হতে বলেছিলেন তিনি।

করোনার মৃত্যুযজ্ঞে  নতুন সংযোজন মৌলানা ওয়াহিউদ্দিনের নামই। বুধবার ভোর রাতে দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ভারত তো বটেই, সারা পৃথিবীর মানুষ হারালেন এক ব্যতিক্রমী ধর্মীয় নেতাকে। আজীবন গান্ধীবাদী নীতিতে বিশ্বাসী ওয়াহিউদ্দিন বিশ্বাস করতেন এই পৃথিবীতে প্রতিটি ধর্ম একে অপরের সঙ্গে মিলেমিশে টিকে থাকতে পারে। হিংসা-হানাহানির বাইরে গিয়ে প্রতিটি ধর্মের মূল কথাই যে মানবিকতা। কোরানের মধ্যেও সেই মানবিক উপাদানের সন্ধান করেছেন আজীবন। ইংরেজি, হিন্দি সহ বেশ কিছু ভাষায় কোরানের সটীক অনুবাদ করেছেন তিনি। এছাড়াও লিখেছেন অসংখ্য বই। তাঁর লিখিত বইয়ের সংখ্যা ২০০-র কম নয়। এর মধ্যে কোরানের অনুবাদের পাশাপাশি আছে ‘দ্য প্রফেট অফ পিস’ বা ‘ইন্ডিয়ান মুসলিমঃ আ নিড ফর পজিটিভ আউটলুক’-এর মতো বই। কয়েকটি বই আরব যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তক হিসাবেও স্বীকৃত।

শুধুই বাবরি মসজিদ বিতর্কে নয়, স্বাধীন ভারতের প্রতিটি সাম্প্রদায়িক অশান্তির মুহূর্তে সামনে থেকে শান্তি প্রতিষ্ঠার মন্ত্র শুনিয়েছেন মৌলানা ওয়াহিউদ্দিন। সমস্ত ধর্মসম্প্রদায়ের উপাসনালয়ের নিরাপত্তার দাবিতে  সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন বারবার। পাশাপাশি মানুষকে বুঝিয়েছেন, ধর্মস্থানের চেয়ে আমাদের অনেক বেশি প্রয়োজন শিক্ষা এবং স্বাস্থ্য। এই দুটি প্রাথমিক বিষয় নিশ্চিত না হলে কোনো জাতির উন্নতি সম্ভব নয়। সাম্প্রদায়িক মৈত্রী প্রতিষ্ঠার স্বীকৃতি হিসাবে তিনি পেয়েছেন পদ্মভূষণ পুরস্কার। গত জানুয়ারিতেই পদ্মবিভূষণ পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। এছাড়া রাজীব গান্ধী সদভাবনা পুরস্কার সহ নানা সম্মান পেয়েছেন তিনি। ভারতের বাইরেও তাঁর মানবতাবাদী চিন্তা প্রভাবিত করেছে অনেককে। ৯৭ বছর বয়সে থেমে গেল সেই সমস্ত প্রয়াস। তবে সশরীরে জীবিত না থাকলেও মৌলানা বেঁচে থাকবেন অসংখ্য মানবতাবাদী মানুষের চিন্তায়, মননে। ভাবনার মৃত্যু হয় না যে।

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
সংক্রমণে বিশ্বের শীর্ষে ভারত, কারণ খুঁজলেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা

More From Author See More